বেসরকারি হাসপাতালে এক ঘণ্টার মধ্যে তিন শিশুর মৃত্যু

লালমাটিয়ার এশিয়ান কার্ডিয়াক অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল
লালমাটিয়ার এশিয়ান কার্ডিয়াক অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল

রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে গত শুক্রবার রাতে এক ঘণ্টার ব্যবধানে তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শিশুমৃত্যুর পরই চিকিৎসক ও হাসপাতালের মালিক পালিয়েছেন। আতঙ্কিত স্বজনেরা রোগীদের অন্য প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রথম আলোকে জানিয়েছে, লালমাটিয়ার এই এশিয়ান কার্ডিয়াক অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালটি ২০১৩-১৪ সালের পর লাইসেন্স নবায়ন করেনি। প্রতিষ্ঠানটির নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (এনআইসিইউ) অনুমোদন ছিল না। গতকাল শনিবার বিকেল চারটার দিকে অধিদপ্তরের একটি দল গিয়ে হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয়।
গতকাল দিনভর অপেক্ষা করেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা চিকিৎসক কাউকেই ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে চেষ্টা করেও শিশুমৃত্যুর কারণ ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পুলিশের মোহাম্মদপুর অঞ্চলের কমিশনার বিপ্লব কুমার দাস বলেন, পুলিশ ঘটনা খতিয়ে দেখছে। রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে তিন শিশু মারা যাওয়ার খবর জানতে পেরে সকালেই ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত ওই তিন শিশুর বয়স ২ মাস ২ দিন, ১৯ দিন ও ৩ দিন। এরা এনআইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিল।
গতকাল সকালে ১৯ দিন বয়সী মৃত শিশুর মা শিল্পী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় ডাক্তার আমাকে দুই দিন আগে বলছিল, আমার বাবুর অবস্থা ভালো। শনিবার রিলিজ দিয়া দিব। শুক্রবার বাবুকে দেইখা আমার ভালো লাগে নাই। আমি ডিউটি ডাক্তারকে বললাম। সে উল্টা ধমক মারে। হঠাৎ সন্ধ্যা সাতটার দিকে হাসপাতালের লোকজন আইসা আমারে বন্ড সই দিতে বলে। বলে যে, বাবুর খুব শ্বাসকষ্ট হইতেছে। রাত ১১টায় আমারে জানায়, বাবু নাই।’
শিল্পী সন্তান নিয়ে ওই হাসপাতালে ছিলেন ১৪ দিন। প্রতিদিন তাঁর খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। তিনি অভিযোগ করেন, সন্তানের শারীরিক অবস্থার প্রকৃত তথ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানায়নি।
মৃত অপর দুই শিশুর অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে তিন শিশুর অভিভাবকেরা আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ করেননি। গতকাল রাত আটটা পর্যন্ত পুলিশও কোনো মামলা করেনি।
গতকাল সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত এনআইসিইউতে জয়া নামের একজন নার্স ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, দুটি শিশুর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। অন্য শিশুটি সময়ের আগে জন্মানোয় জটিলতায় ভুগছিল।
জয়া জানান, শিশির রঞ্জন দাস নামের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনআইসিইউর দায়িত্বে। দিনের সব সময় থাকেন না। সকালে ও রাতে নিজের সুবিধামতো ঘুরে যান। তবে শুক্রবার রাতে শিশুগুলোর মৃত্যুর সময় তিনি হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) শামিউল ইসলাম বলেছেন, হাসপাতালটিতে এনআইসিইউ চালানোরও অনুমতি ছিল না। ৫০ শয্যার হাসপাতালটির ৩৪টি শয্যা জটিল রোগীদের জন্য বরাদ্দ ছিল।
এক ঘণ্টার ব্যবধানে তিন শিশুর মৃত্যুর খবরে রোগীর স্বজনেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাঁরা অ্যাম্বুলেন্সে, স্ট্রেচারে করে রোগীদের সরিয়ে নেন। কাউকে কাউকে পাঁজাকোলা করে সরাতে দেখা যায়। দুপুর ১২টা নাগাদ পুরো হাসপাতাল খালি হয়ে গেলে এই প্রতিবেদক বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখেন। সালমা বেগম নামের গোপালগঞ্জ থেকে আসা এক রোগীর ফাইল পড়ে থাকতে দেখা যায় দুই শয্যার একটি নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে। ওই রোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এই হাসপাতালে আসেন। তিনি ভর্তি ছিলেন প্রফেসর মোজাফফর নামের একজন বিশেষজ্ঞের অধীনে।
একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ রোগীই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একটি দালাল চক্রের মাধ্যমে লালমাটিয়ার এই হাসপাতালে আসে। মূলত শিশির রঞ্জন দাস হাসপাতালটি চালান। বছর তিনেক আগে শিশির রঞ্জন দাস ঢাকা মেডিকেল কলেজের নবজাতক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে তাঁকে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। বছর খানেক আগে তাঁকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে বদলি করা হলেও তিনি সেখানে যাননি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ পর্যন্ত তিন দফা হাসপাতালের মালিকানা বদল হয়েছে। ২০০৩ সালে হাসপাতালটি চালু করেছিলেন আলী মনসুর নামের এক ব্যবসায়ী, সঙ্গে ছিলেন আরও তিনজন। আলী মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাভজনক না হওয়ায় মাসুদুর রহমানসহ কয়েকজনের কাছে হাসপাতালটা ২০১৩ সালে বিক্রি করে দেই। ওরা আবার নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়ার বিনিময়ে কাদের কাছে যেন ছেড়ে দিয়েছে।’ জানা গেছে, হাসপাতালটি ভাড়া নিয়েছেন শিশির রঞ্জন দাস ও আবদুল্লাহ আল শিহাব। তবে এসব তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জানা নেই।
চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজনেরা জানান, এই হাসপাতালে একবার ঢুকলে খুব সহজে ছাড়া পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। নানা ছলছুতোয় রোগীদের ধরে রাখা হয়। রোগীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানানো হয় না। ঝরনা বেগম নামের এক নারীর নাতি হাসপাতালটির এনআইসিইউতে ভর্তি ছিল। তিনি বলেন, ‘চাইর দিনে ছয়টা বাইচ্চা মারা গ্যাছে। স্বীকার করতেছে না। কাইলকা একটা বাচ্চা মইরা নীল হইয়া গ্যাছে। তারপর রোগীর লোকরে খবর দিছে।’