অচল রাজধানী চরম ভোগান্তি

হরতালের সমর্থনে গতকাল বিকেলে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় শিবিরের ঝটিকা মিছিল থেকে বাসে ইট নিক্ষেপ (ইনসেটে) করা হলে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই হুড়োহুড়ি করে বাসের জানালা ও দরজা দিয়ে নামতে থাকেন ষ ছবি: প্রথম আলো
হরতালের সমর্থনে গতকাল বিকেলে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় শিবিরের ঝটিকা মিছিল থেকে বাসে ইট নিক্ষেপ (ইনসেটে) করা হলে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই হুড়োহুড়ি করে বাসের জানালা ও দরজা দিয়ে নামতে থাকেন ষ ছবি: প্রথম আলো

একটি ব্যাগ ঝুলছে কাঁধে। তাতে কাপড়-চোপড়। অন্যটি হাতে। এতে ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর খুচরা যন্ত্রপাতি। মনির হোসেন যাবেন রাজবাড়ী। গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে বাসে উঠবেন। সে জন্য তাঁকে গাবতলীতে পৌঁছাতে হবে আগে। কিন্তু গাবতলী পর্যন্ত যাওয়ার কোনো যানবাহনই পাচ্ছিলেন না তিনি।
তোপখানা রোডের কদম ফুল ফোয়ারার মোড় পর্যন্ত মনির হেঁটে এসেছেন বায়তুল মোকাররম মার্কেট থেকে। ইলেকট্রনিকস সামগ্রী মেরামতের কাজ করেন তিনি। গত শনিবার ঢাকায় এসেছিলেন কিছু খুচরা যন্ত্রাংশ কিনতে। আজ সোমবার থেকে শুরু হবে তিন দিনের হরতাল। তাই গতকাল রোববার দুপুর নাগাদ কেনাকাটা শেষ করে বিকেলেই তিনি ফিরতি পথ ধরেছিলেন। কিন্তু বিপত্তিতে পড়তে হলো গাবতলী পর্যন্ত যেতেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছিল জেল হত্যা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের সমাবেশ। মিছিলের পর মিছিল আসছিল সমাবেশে। পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছিল শাহবাগ, মৎস্য ভবন, কার্জন হলের সামনের সড়ক। এ কারণেই গাবতলী যাওয়ার কোনো বাহন পাচ্ছিলেন না মনির হোসেন। সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা পেয়েছিলেন। চালক ভাড়া হাঁকেন ৩০০ টাকা। এরপর আর অটোরিকশা ডাকার সাহস পাননি তিনি। চেষ্টা করছিলেন বাসে ওঠার। পথে হরেক রকম যানবাহন। কিন্তু সেগুলো অনড়। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলছে অসংখ্য মানুষ। তাদের মধ্যে অনেকেই অফিস-ফেরতা। কথা হলো শিক্ষা ভবনের অডিট কর্মকর্তা আবদুল লতিফের সঙ্গে। উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরে তাঁর বাড়ি। স্টাফ বাসেই যাতায়াত করেন। পথ রুদ্ধ থাকায় সেই বাস ছাড়েনি। অগত্যা নিজ উদ্যোগেই বাড়ি ফেরার জন্য তিনি সার্ভিস বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

আবার তো তিন দিনের হরতাল শুরু হচ্ছে, উত্তরা থেকে যাতায়াতের কী ব্যবস্থা? মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ জানালেন, হরতালের দিন স্টাফ বাস চলে না। অফিসে যাতায়াত করতে খুবই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বাড়ি থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত রিকশা বা হেঁটে আসেন। সেখান থেকে কোনো কোনো দিন সার্ভিস বাস পাওয়া যায়। কপাল ভালো হলে বাসে মহাখালী পর্যন্ত আসা যায়। তারপর আবার খানিক রিকশা, খানিকটা হেঁটে অফিসে পৌঁছানো। যাতায়াত করতে দেড় শ-দুই শ টাকা খরচ হয়ে যায়। গত মাসে হরতালের দিনগুলোতে এভাবেই অফিসে যাতায়াত করেছেন বলে জানালেন তিনি।

ক্ষমতাসীন দলের সমাবেশ আর বিরোধী দলের হরতাল নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে গতকালের দিনটি গেছে নগরবাসীর। নগরের কেন্দ্রস্থলে ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে দুপুর থেকেই শাহবাগ এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় বিকল্প পথগুলোতে ছিল দুর্বিষহ যানজট। এর প্রভাব পড়েছে নগরের পাড়া-মহল্লার সড়কগুলোতেও। যাত্রাবাড়ী থেকে মিরপুর পর্যন্ত সড়কগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়ে। বিকেলে অফিস-ফেরতা চাকরিজীবী এবং বিভিন্ন স্কুল-কলেজের দিবা শাখার শিক্ষার্থীরা ছুটির পর বাড়ি ফিরতে প্রচণ্ড দুর্ভোগে পড়ে।

বেলা তখন পৌনে পাঁচটা। মুগদাপাড়ার বিথি সুলতানা বেইলি রোডের ভিকারুননিসা স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মেয়ে তাবাসসুমকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন রিকশার জন্য। পুরো বেইলি রোড, শান্তিনগর ও সিদ্ধেশ্বরী রোড তখন অচল হয়ে আছে। ভাড়াটা তখন আর বিবেচ্য বিষয় নয়, খালি রিকশাই পাচ্ছিলেন না তিনি। বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘পত্রিকায় লিখে কী হবে, আমাদের এই হয়রানি কি কমবে? কাল থেকে আবার শুরু হবে হরতাল। ডিসেম্বরে মেয়ের পরীক্ষা। ক্লাস তো হবেই না। হয়তো কোচিং করতে আসতেও পারবে না।’

পথের জটলা ছিল সমাবেশ শেষ হওয়ার পরেও। তাই বেশ খানিকটা রাত অবধি গতকাল যানজটের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। কাজ শেষে বাসায় ফিরতে রাত হয়েছে অনেকের। অনেকেই যথাসময়ে পৌঁছাতে পারেননি গন্তব্যে।

আজ সোমবার থেকে অবশ্য পথে এই জটলা থাকবে না বটে, তবে সেই না থাকাটাই আবার পরিণত হবে আরেক দফা ভোগান্তির কারণে। কবে যে এ থেকে পরিত্রাণ মিলবে, সেটাই এখন নিরুপায় নাগরিকের প্রধান জিজ্ঞাসা।