খাদ্যনিরাপত্তায় এগিয়ে বাংলাদেশ

জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) পূরণের ক্ষেত্রে কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবচেয়ে সফল। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি ইন ওয়ার্ল্ড-২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, কিউবা, মাদাগাস্কার ও ভিয়েতনাম দুর্যোগ মোকাবিলা করেও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে।
পুষ্টি নিরাপত্তায়ও বাংলাদেশের অগ্রগতি ভালো। তবে সামগ্রিক বিচারে এখনো বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ খারাপ। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের খর্বাকৃতি, কৃশকায় বা শুকনো ও অপুষ্ট হওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে রয়েছে। চলতি মাসে প্রকাশিত এফএওর ‘এগ্রিকালচারাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল পকেট বুক-২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
খাদ্যনীতি গবেষণাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইফপ্রি প্রকাশিত ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ’৭০-এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর বাংলাদেশে প্রবল খাদ্য-সংকট দেখা দিয়েছিল। ’৭১-এ নয় মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধেও বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দেশটিতে বেশির ভাগ খাদ্য উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়েছে। বিশেষ করে এই সময়ে চালের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে।
ইফপ্রির ওই প্রতিবেদনে বিশ্বের ১০৫টি দেশকে বিবেচনা করে বলা হয়েছে, ক্ষুধা নির্মূলে বাংলাদেশ ১৯৯০ সাল থেকে এ সময়কালে দ্বিগুণ সাফল্য দেখিয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা জনগোষ্ঠীর পরিমাণ কমিয়ে আনা, অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা ও খর্বাকৃতি শিশুর সংখ্যা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫২ দশমিক ২। ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো হয়ে ২৭ দশমিক ৩ হয়েছে। ওই তিনটি ক্ষেত্রে সাফল্য আসাতেই বাংলাদেশের অবস্থানের এই উন্নতি হয়েছে।
এ ব্যাপারে ইফপ্রি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী আখতার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশের ধারাবাহিক সাফল্য এসেছে কৃষকদের পরিশ্রম ও বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনের ফলাফল হিসেবে। তবে সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ এবং তার সফল প্রয়োগ এ ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে।
ইফপ্রির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০১ সালে বাংলাদেশের খাদ্যশক্তির ৯০ শতাংশ জোগান আসত ভাত ও আলুজাতীয় খাদ্য থেকে। ২০১১ সালের পর তা কমে ৮০ শতাংশেরও নিচে নেমে আসে। কোনো একটি দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার অন্যতম সূচক হিসেবে সেই দেশের মানুষের খাদ্যশক্তির প্রধান উৎস কী, তাকে আমলে নেওয়া হয়নি। খাদ্যশক্তির উৎস হিসেবে ভাত ও আলুর ওপরে নির্ভরশীলতাকে এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক এবং সবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও ফলের ওপর নির্ভরশীলতাকে ইতিবাচক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
ইফপ্রির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ গত এক যুগে সবজি, মাছ, ডিম ও মাংস উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে। মাথাপিছু আয় বা ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। এর ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ ভাত ও আলুর পাশাপাশি খাদ্যশক্তির অন্যান্য উৎসের উৎপাদন বাড়িয়েছে এবং তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসতে শুরু করেছে।
এ ব্যাপারে এফএও বাংলাদেশের দেশীয় প্রতিনিধি মাইক রবসন প্রথম আলোকে বলেন, কৃষি খাতে বাংলাদেশের সফলতা বিশ্বের জন্য অনুকরণীয়। এত কম আয়তন, বিপুল জনসংখ্যা এবং সম্পদের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছে। নতুন নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবন করে তা কৃষকদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে। এতে একদিকে খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে, খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত হচ্ছে।
এফএওর এগ্রিকালচারাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল পকেট বুক-২০১৫ অনুযায়ী, প্রাকৃতিক উৎস থেকে খাদ্য সংগ্রহের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৬তম, মাছ চাষের দিক থেকে বিশ্বের পঞ্চম, অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার দিক থেকে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে।
তবে শিশুদের অপুষ্টি, খর্বাকৃতিসহ বেশ কিছু দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখনো বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের কম ওজন থাকার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের পঞ্চম। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যথাক্রমে পূর্ব তিমুর, লেসোথো, ইরিত্রিয়া, নাইজার ও ইয়েমেনে।
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের খর্বাকৃতি হওয়া সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের ১৬তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে ভারত ও নেপালের অবস্থা আরও খারাপ। ভারতের অবস্থান অষ্টম ও নেপালের অবস্থান ১১তম। আর খর্বাকৃতি শিশু সবচেয়ে বেশি যথাক্রমে বুরুন্ডি, তিমুর, লেসোথো ও নাইজারে। শুকনো বা কৃশকায় শিশুদের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দক্ষিণ সুদানের।