একজন সংগ্রামী মানুষ

রঞ্জিত রায়ের (বাঁয়ে) মাদ্রাসার খোঁজখবর নিলেন আসাদুজ্জামান নূর। ছবি: মঈনুল ইসলাম
রঞ্জিত রায়ের (বাঁয়ে) মাদ্রাসার খোঁজখবর নিলেন আসাদুজ্জামান নূর। ছবি: মঈনুল ইসলাম

আমার সামনে সলজ্জ ভঙ্গিতে বসে আছেন রঞ্জিত কুমার রায়। হাতে একটা ছোট পুঁটলি।

কুশল বিনিময়ের পর চা এল। চা খেতে খেতে রঞ্জিতের সঙ্গে কথা হলো।

রঞ্জিত কুমার রায়ের কথা মনে আছে কি? ২০১১ সালের ৯ মার্চ প্রথম আলোর শেষের পাতায় তাঁর সম্পর্কে একটা লেখা ছবিসহকারে ছাপা হয়েছিল। গায়ে একটি ছেঁড়া গেঞ্জি, পরনের প্যান্টটাও ময়লা ও পুরোনো। প্রচণ্ড রোদে ইটের ভাটায় কাজ করছেন। ঘাম ঝরছে দরদর করে।

মাদ্রাসার শিক্ষক রঞ্জিত রায়। গ্র্যাজুয়েট। নীলফামারী সদর উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের ‘বেড়াকুঠি বড়ুয়া দাখিল মাদ্রাসা’র প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক তিনি। তাঁর নিবাস অবশ্য দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলার ডুবুলিয়া গ্রামে। এমপিওভুক্ত না হওয়ার কারণে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত এ মাদ্রাসাটি চরম অবহেলার মধ্যে পড়ে আছে।

এমপিও (মান্থলি পে অর্ডার) এক আলাউদ্দিনের আশ্চর্য চেরাগ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এটি সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত শব্দ। বাংলাদেশের অসংখ্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকমণ্ডলী চেয়ে আছেন এমপিওভুক্ত কবে হবে, সেই আশায়।

এমপিও কবে চালু হয়েছিল ঠিক জানি না। বেসরকারি স্কুলের মানোন্নয়ন এবং শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিশ্চিত করে তাঁদের জীবনে সচ্ছলতা প্রদান ছিল এমপিওর উদ্দেশ্য। কিন্তু এতে করে যা ঘটল সেটা হলো বাংলাদেশের অসংখ্য শিক্ষিত বেকার মানুষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে লাগলেন এই আশায় যে কোনো একদিন এমপিওভুক্ত হবে। ফলে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে লাগল। সরকার প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করেও সব শিক্ষককে এই সুবিধার আওতাভুক্ত করতে সক্ষম হয়নি। ফলে দীর্ঘদিন ধরে অসংখ্য শিক্ষক বিনা বেতনে পড়িয়ে চলেছেন বছরের পর বছর। রঞ্জিত রায় তাঁদেরই একজন।

কীভাবে চলে রঞ্জিতের সংসার? আসলে চলে না। স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ চারজনের সংসার—অভাব তাঁর নিত্যসঙ্গী। ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। জমিজমা নেই এক ছটাক। তাই জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ইটের ভাটায় দিনমজুরের কাজ।

খুব অল্প বয়সে বাবা মারা যান। বাবা কৃষিকাজ করতেন। দিদির সংসারে বড় হয়েছেন। কিন্তু লেখাপড়া করার ব্যাপারে ছিলেন স্থিরপ্রত্যয়ী। তাই সব কষ্ট উপেক্ষা করে শ্রম বিক্রি করে, ছাত্র পড়িয়ে বিএ পাস করেন দিনাজপুর কেবিএম কলেজ থেকে। কিন্তু এই সাফল্য জীবনে কোনো স্বস্তি এনে দিল না। বরং বোঝা বেড়ে গেল। গ্র্যাজুয়েট—চাকরি খুঁজে ব্যর্থ হলেন। কয়েকজন মিলে পরামর্শ করে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন এই মাদ্রাসা। আশা ছিল আজ না হলে কাল, কাল না হলে পরশু এমপিওভুক্ত হবে, সুদিন আসবে। সচ্ছলতার মুখ দেখবে অনেক পরিবার। এক যুগেরও বেশি সময় কেটে গেল, সেই সুদিন আজও আসেনি।

প্রথম আলোয় খবরটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সহূদয় ব্যক্তি এগিয়ে এলেন, বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের হাত, সহায়তা দিল প্রথম আলো। যে মানুষটি তিল তিল করে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলেন, ফিরে পেলেন নতুন জীবন।

সব মিলিয়ে প্রায় তিন লাখ টাকা এল তাঁর হাতে। পাওনাদারের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ছিলেন রঞ্জিত। দেনা শোধ করলেন পুরোটাই। ভাঙা ঘরটির সংস্কার করলেন। প্রথম আলোর সাহায্যে মাদ্রাসার একটি ঘর পাকা করা হলো। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে প্রদান করা হলো কিছু অনুদান এবং আমার সামান্য কিছু ব্যক্তিগত সহায়তা। গড়ে উঠল মাদ্রাসার আরও কিছু ঘর। অবকাঠামোগত দিক থেকে মাদ্রাসাটি এখন মোটামুটি ভালো অবস্থায় আছে বলা যায়। কিন্তু শিক্ষকদের অবস্থা অপরিবর্তিত, রঞ্জিতেরও তা-ই। এবার পূজায় ছেলেমেয়েদের নতুন কাপড় কিনে দিতে পারেননি, স্ত্রীর ভাগ্যেও জোটেনি নতুন শাড়ি। তবুও রঞ্জিত খুশি। অসীম কৃতজ্ঞতা প্রথম আলোর প্রতি, সম্পাদক মতিউর রহমানের প্রতি।

মতিউর রহমান গিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে, মাদ্রাসাও পরিদর্শন করেছেন। সঙ্গে আমিও ছিলাম। মতিউর রহমান তাঁর বাড়িতে গেছেন—রঞ্জিত মনে করেন এটি তাঁর জীবনে একটি স্মরণীয় ঘটনা।

রঞ্জিতের ভাষ্য, ‘প্রথম আলো আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে, আমার পরিবারকে বাঁচিয়েছে, আমার অবস্থা, আমার মতো শিক্ষকদের অবস্থা তুলে ধরেছে সারা দেশের মানুষের সামনে।’

এখন তাঁর একমাত্র আবেদন, আমাদের এমপিওটা করে দ্যান, আমরা মানুষের মতো বাঁচি। আমরা প্রকৃত শিক্ষক হতে চাই, শিক্ষকের মর্যাদা চাই।

রঞ্জিত চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। আমার হাতে ছোট পুঁটলিটা তুলে দিলেন। পুঁটলিটা খুলে দেখলাম কিছু নাড়ু, খই, মুড়কি। দুর্গাপূজা উপলক্ষে সামান্য কিছু প্রসাদ এনেছেন আমার জন্য। গভীর আনন্দে মনটা ভরে গেল। বিদায় জানালাম রঞ্জিতকে। তাকিয়ে দেখলাম ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন একজন সংগ্রামী মানুষ—রঞ্জিত কুমার রায়।

আসাদুজ্জামান নূর: সাংসদ; সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব