লিমন একটি ছেলের নাম

লিমন (বাঁয়ে) তাঁর সংগ্রামী জীবনকথা বলছেন সুলতানা কামালকে। ছবি: সাহাদাত পারভেজ
লিমন (বাঁয়ে) তাঁর সংগ্রামী জীবনকথা বলছেন সুলতানা কামালকে। ছবি: সাহাদাত পারভেজ

কিছু কিছু সম্পর্ক আছে, সেগুলো কেমন করে অবিচ্ছেদ্য হয়ে যায়; কোন কারণেই বা তা হয়, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। এ কদিন আগেও, বছর দুয়েক হবে, ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া বলে যে একটি গ্রাম আছে, সে কথাও আমার ভৌগোলিক জ্ঞানের মধ্যে ছিল না। আর সেই গ্রামের একটি কিশোর বয়সের ছেলে, যার নাম লিমন, তারও কোনো অস্তিত্ব ছিল না আমার জীবনে। নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমিও লিমনের কাছে ছিলাম তেমনই অপ্রাসঙ্গিক। একটি মর্মান্তিক ঘটনা লিমনকে একঝটকায় আমার ভাবনা, আমার উদ্বেগ, আমার ক্রোধের এক বিরাট অংশ বানিয়ে দিল। ঠিক যেমনটি ঘটেছিল পার্থ সাহার ব্যাপারেও সেই ২০০৫ সালে।

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে লিমনের সঙ্গে কথা বলার সময় আমি তার চোখেমুখে দেখেছি এক সাহসী বাংলাদেশের চিত্র। তার জন্য আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। বেশ কয়েকবারই তার সঙ্গে দেখা করেছি। কথা বলেছি। প্রতিবারই মনে হয়েছে, লিমন আমাদের সংগ্রামী জীবনের প্রতীক।

সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেছে লিমন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে প্রবেশ করার অভিপ্রায়ে আর দশটা ছেলের মতো সেও কোচিং নিচ্ছে। ঢাকায় তার থাকার কোনো সংস্থান নেই। তার মা বহু চেষ্টা-চরিত্র করে আরও কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে ফার্মগেটে তার একটা থাকার ব্যবস্থা করেছেন। লিমনের মা হেনোয়ারা বেগমের সাহসের তুলনা পাওয়া ভার। অসীম শক্তির অধিকারিণী এই নারী র‌্যাবের গুলিতে একটি পা হারানো তাঁর এই ছেলেকে নিয়ে কী সংগ্রামই না করে যাচ্ছেন। লিমনের ইচ্ছা, সে আইন নিয়ে পড়াশোনা করবে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে আশ্বাস দিয়েছে, যদি সে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে পারে, তবে সেখানে পড়ার সুযোগ পাবে।

দেশের আইন তার শারীরিক নিরাপত্তা বিধান করতে পারেনি, বরং অন্যায় ও আইনবহির্ভূতভাবে যখন সে পা হারাতে বাধ্য হলো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে, তারও প্রতিকারে সে এখনো কোনো ন্যায়বিচার পায়নি। শুধু তা-ই নয়, উল্টো রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধেই একের পর এক মামলা ঠুকে গেছে। তাই হয়তো তার আইন পড়ে দেখার ইচ্ছা যে তার মতো সাধারণ মানুষের সুরক্ষা দেওয়ার মতো কী আছে এ দেশের বিধানে!

এই ছেলেটি যখন মাত্র বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়ে কলেজে প্রবেশ করেছে, সেই ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে নিজের বাড়ির কাছে মায়ের নির্দেশে মাঠ থেকে গরু আনতে গেলে র‌্যাবের সদস্যরা তাকে ধরে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। সেই গুলিতে তার পা এমনভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয় যে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করেও তার পা’টা রক্ষা করা যায়নি। জীবন বাঁচাতে পা’টা কেটে ফেলতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে র‌্যাবের ভাষ্য, লিমন একজন বিশেষ পরিচিত সন্ত্রাসী। স্পষ্টত লিমনকে তারা অন্য এক নামে অভিযুক্ত করতে চাইছিল।

আগেই বলেছি, ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া বলে এক ছোট্ট গ্রামে লিমনের বাস। সেই গ্রামের রাস্তা ধরে এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে সন্ধ্যা নদীর পাড় ঘেঁষে পাঁচ শতাংশ জায়গার ওপর লিমনদের টিনের ঘর, যেটা গত বছর ভেঙেও পড়েছিল। তারা দুই ভাই, এক বোন। লিমনের ওপর র‌্যাবের আক্রমণের পর তাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করার কারণে ভাইটির চাকরি চলে গেছে। বহু অধ্যবসায়ের পর ভাই শেষ পর্যন্ত বিএ পরীক্ষা দিচ্ছে। বোনের বিয়ে হওয়ায় শ্বশুরবাড়িতে চলে গেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, এ ঘটনায় লিমনের মামাও তার চিকিৎসা চলাকালীন সার্বক্ষণিক দেখভাল করতে চাকরি ছেড়ে দেন।

লিমনের বাবা সেই সময় ফলের দোকানে কাজ করতেন, এখন ছোটখাটো একটা ফলের দোকান দিয়েছেন। তবে তাদের দিনে আনা দিনে খাওয়ার অবস্থার কোনো উত্তরণ ঘটেনি। লিমনের পড়াশোনার ভার বহন করছে তার প্রতি সহানুভূতিশীল কিছু মানুষ।

কিশোর বয়স পার হতে না-হতে লিমন কত কিছুই না অভিজ্ঞতা অর্জন করল। একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনী তার পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়। কোনো অজুহাতেই তার সঙ্গে তারা যে আচরণ করেছে, তা করতে পারে না। কারণ, আমাদের সংবিধান বা প্রচলিত আইন অথবা এই বিশেষ বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা—কোথাও এই আচরণের অনুমোদন নেই। তার পরও এই বাহিনী বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দুঃখ প্রকাশ বা অনুশোচনার বিন্দুমাত্র পরিচয় পায়নি লিমন। উল্টো নিজেদের অপরাধ ঢাকতে রাষ্ট্রপক্ষ স্থানীয় কিছু দুর্বৃত্তের সঙ্গে তাকে আসামি করে রাজাপুর থানায় দুটি মামলা করে। একটি করা হয় অস্ত্র আইনে, অন্যটি সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অপরাধে।

লিমন যে এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নয়, নানাভাবে সে কথা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও র‌্যাব ক্ষান্ত হয়নি। তার বিরুদ্ধে এক বছর পরে অভিযোগপত্র করে ছাড়ল তারা। সে বছরের আগস্ট মাসে ঈদের দিনে লিমনের ওপর হামলা চালায় কিছু দুর্বৃত্ত। এতে আহত হন তার মা এবং হামলার কারণে তার কানের পর্দা ছিঁড়ে যায়। একদিকে কিশোর বয়সের লিমন, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা পর্যন্ত শুধু লিমন নয়, লিমনের পুরো পরিবার সন্ত্রাসী—এই মর্মে বক্তব্য দিয়ে বসেন। অথচ তার ওপর র‌্যাবের আক্রমণের কয়েক দিনের মাথায়ই উচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঘটনার তদন্তের জন্য রুল জারি করেন। সেই অবস্থায়ই তদন্তের কোনো অগ্রগতি না করেই তাকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও তাদের পেটোয়া বাহিনী নানা হুমকি দিতে থাকে, যার একটি ফল হলো ঈদের দিনে লিমনের পরিবারের ওপর হামলা।

সেই সময়টায় লিমনের পুরো পরিবার গ্রেপ্তার-আতঙ্কে পালিয়ে বেড়িয়েছে। ইতিমধ্যে র‌্যাবও লিমনের ঘটনা সম্পর্কে নানা ভাষ্য দিয়ে গেছে। তারা এমনও বলেছে যে লিমন সন্ত্রাসী নয়, পরিস্থিতির শিকার। অথচ তার বিরুদ্ধে একের পর এক হয়রানিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে বিরত থাকেনি। অন্যপক্ষে হেনোয়ারা বেগমের নির্দিষ্ট করে ডিএডি লুৎফর রহমানসহ কয়েকজন র‌্যাব সদস্যকে অভিযুক্ত করে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তারা দায়সারা তদন্ত করে বক্তব্য দেয়, র‌্যাবের কার গুলিতে লিমন পঙ্গু হয়েছে, তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি।

একসময় র‌্যাবের অভিযুক্ত ডিএডি লুৎফর রহমানসহ ছয় সদস্যকে অব্যাহতি দেওয়ারও সুপারিশ করা হয় হেনোয়ারা বেগমের করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে। অন্যদিকে সাধারণ জনগণ ও নাগরিকদের চাপে ঘটনা এমন রূপ নেয় যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বলেন, লিমনকে নিয়ে যেন কোনো মন্তব্য না করা হয়। অথচ অদৃশ্য কারও প্রভাবে গণমাধ্যম থেকে সেই বক্তব্য তুলে ফেলা হয় এবং নিরপরাধ এ কিশোর দুটি মামলা মাথায় নিয়েই পরীক্ষায় বসতে বাধ্য হয়। তুলনাবিহীন নিষ্ঠুরতার উদাহরণ রেখে পুলিশ ক্রমাগত তার পরীক্ষার ঠিক আগে আগে তাকে আদালতে হাজিরা দেওয়ার নোটিশ দিয়ে যেতে থাকে। তদুপরি সেই বছরই লিমনের মা-বাবা আর ভাইয়ের বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা হত্যা মামলা দিয়ে বসল পুলিশ। যাকে হত্যা করার অভিযোগে মামলা করা হলো, একটা সময়ে প্রমাণিত হলো, সেই ব্যক্তির মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক। তত দিনে লিমনদের যত রকম হয়রানি করা প্রয়োজন, তা করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি পুলিশ।

এত কিছুর পরও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৪ পেল লিমন। সে পঙ্গু হয়েছে, শ্রবণশক্তি হারিয়েছে, ভয়ে থাকতে থাকতে কিশোর জীবনের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার স্পৃহা আর গতি হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে সে। ছেলেটি হয়তো আরও অনেক না-জানা ও অখ্যাত মানুষ, যারা এ ধরনের ধারাবাহিক রাষ্ট্রীয় সহিংসতা আর সন্ত্রাসের শিকার হয়, তাদের মতো সবার অগোচরে একদিন হারিয়েই যেত, যদি তার অসীম সাহসী মা হেনোয়ারা বেগম সব শক্তি দিয়ে লিমনের সংগ্রামটা চালিয়ে না যেতেন, আর যদি বাংলাদেশের আইনজীবী, চিকিৎসকসহ নানা পেশার নানা মানুষ লিমনের পাশে এসে না দাঁড়াতেন।

এর মধ্যেও সরকারের কূটকৌশল থেমে থাকেনি। নানাভাবে লিমনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে র‌্যাবের বিরুদ্ধে তার মায়ের করা মামলা তুলে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। ২০১১ সালে করা অস্ত্র মামলার অভিযোগপত্র দিতে সময় নিয়েছে দুই বছর, যাতে লিমনের আইনি লড়াইয়ের কালক্ষেপণ হতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত চলতি বছরের জুলাইয়ে লিমনকে তার বিরুদ্ধে করা মামলা থেকে রেহাই দেওয়া হয়।

লিমনকে ঢাকা থেকে ঝালকাঠি, ঝালকাঠি থেকে ঢাকা দৌড়াতে হয়েছে অনবরত। নিতে হয়েছে নানা চিকিৎসা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সে তার পরও কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পড়া শেষ করেছে। চেষ্টা করছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। পরিবার আর সুহূদজনের সমর্থনে কোনো রকমে মন শক্ত রেখে সামনের দিকে এগোতে চাইছে সে। মনে তার বড় খেদ, এ দেশে নিরীহ লোক রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে হয়রানির শিকার হলে, অত্যাচারিত হলে তার বিচার পাওয়া যায় না। আজ পর্যন্ত র‌্যাবের বিরুদ্ধে করা মামলার কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হচ্ছে না। উপরন্তু, রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই মামলা তুলে নেওয়ার জন্য তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। নিরীহ একটি ছেলেকে অন্যায়ভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার মামলার সঙ্গে, লিমনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের মিথ্যা মামলার সমীকরণ করে লিমনের পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করার।

দেখা হলে একটা আবেদন থাকে লিমনের। তা হলো, তার জন্য আমরা যেন দোয়া করি, যাতে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, মা-বাবার দুঃখ ঘোচাতে পারে। আর দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে একটি কথাই বেরিয়ে আসে লিমন নামের ছেলেটির মুখ থেকে, এ দেশে যেন অন্যায়ের বিচার হয়, নিরীহ লোককে যেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর নিপীড়নের শিকার হতে না হয়। আমাদের সবার আকাঙ্ক্ষা মিলে যায় লিমন নামের এই ছেলেটির বুকফাটা আর্তির সঙ্গে।

লিমন ভালো থাকুক, লিমনরা ভালো থাকুক। অপরাধী যে-ই হোক না কেন, তাদের আইনের ঊর্ধ্বে থাকার সংস্কৃতি শেষ হোক। কেউ যেন আর লিমনের মতো দুর্ভাগ্যের শিকার না হয় এই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে।

সুলতানা কামাল: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক; সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা