বাংলাদেশ একদিন বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাবে

জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী

গত মাসের প্রথম সপ্তাহে কয়েকজন তরুণ গণিত তারকা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় এরা পদক জয় করে করেছে—রৌপ্য, ব্রোঞ্জ, অনারেবল। তাদের সঙ্গে কথা বললাম। এরা বাংলাদেশের জন্য গৌরব বয়ে এনেছে। জয়ের যাত্রা শুরু...

গণিত অলিম্পিয়াডের ধারণাটি নিয়ে প্রথম আমার সঙ্গে আলোচনা করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। সে প্রায় এক যুগ আগে। সে সময় প্রথম আলোর ‘নিউরনে অনুরণন’ পাতার মাধ্যমে তরুণ পাঠকদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছে গণিত। মোহাম্মদ কায়কোবাদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবাল গণিতের মতো একটি বিষয়ের ওপর সমস্যা সমাধানে তরুণদের, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা জোগাতে গণিত অলিম্পিয়াডের আদলে জাতীয় প্রতিযোগিতা আয়োজনে উদ্বুদ্ধ হন। এরই ফলে মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং শাবিপ্রবির তখনকার গণিতের অধ্যাপক প্রয়াত গৌরাঙ্গ দেব ২০০৩ সালে শাবিপ্রবিতে এ প্রতিযোগিতা আয়োজনের উদ্যোগ নেন। সে অনুষ্ঠানের সমাপনীতে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় প্রধান অতিথি হিসেবে।

আমরা বহু বছর ধরে অনুধাবন করছিলাম, বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের গণিতের প্রতি একটি ভীতি জন্মে। আর অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকেরাও এ ভীতি দূর করতে সচেষ্ট হন না। এর ফলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান শাখায় শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে কমে যাচ্ছিল। মুখস্থনির্ভর এ শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে অন্ততপক্ষে গণিত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ভীতি দূর করে গণিতে কীভাবে আগ্রহী করে তোলা যায় আর অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায়, সে ব্যাপারে আমরা আলোচনা শুরু করি। তখনই সিদ্ধান্ত হয় যে জাতীয় পর্যায়ে অলিম্পিয়াড আয়োজনের জন্য একটি কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। যেহেতু প্রথম আলো প্রথম থেকেই এ বিষয়ে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করছিল, এ জন্য আমরা কমিটিতে খ্যাতনামা গণিতের অধ্যাপক, বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের অধ্যাপক, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুমকে কমিটিতে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। সবার অনুরোধে আমি কমিটির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করি। সিদ্ধান্ত হয় ঢাকার মধ্যে এ আয়োজন সীমাবদ্ধ না রেখে ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে দেওয়া। পাশাপাশি প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গণিতের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে (আইএমও) যে প্রশ্নপত্র করা হয়, তার মান বাংলাদেশের গণিত স্নাতক (সম্মান) পাঠ্যসূচির সমান। কিন্তু অংশগ্রহণকারীদের যোগ্যতা হলো সর্বোচ্চ প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের। সুতরাং আমাদের শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই আইএমওতে গিয়ে সাফল্য অর্জন করতে পারবে না।

আমরা সিদ্ধান্ত নিই, অন্যান্য দেশের যদিও এ ধরনের প্রতিযোগিতা শুধু প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়, কিন্তু আমরা জাতীয় অলিম্পিয়াডে প্রাইমারি পর্যায় থেকে শুরু করে এইচএসসি পর্যায় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে আমন্ত্রণ জানাতে পারি। এ জন্য অংশগ্রহণকারীদের চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগগুলো হলো প্রাইমারি, জুনিয়র, সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি। দেশব্যাপী এ আয়োজন করতে আমাদের যে বাজেট প্রণীত হলো, তাতে দেখা যায়, এটা শুধু অংশগ্রহণকারীদের বা অন্যান্য পৃষ্ঠপোষক থেকে টাকা নিয়ে সংকুলান হওয়া বেশ দুরূহ ব্যাপার। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান প্রস্তাব করেন, আমরা অর্থায়নের জন্য ডাচ্-বাংলা ব্যাংককে অনুরোধ করতে পারি। তিনি ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এম সাহাবুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কথা বলেন এবং আমরা কয়েকজন সাহাবুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ব্যাংকের সদর অফিসে যাই। আমাদের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার পর চেয়ারম্যান সাহেব প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা করার সম্মতি দেন।

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের জন্য গৌরব বয়ে আনা তরুণদের গল্প শুনছেন জামিলুর রেজা চৌধুরী (ডানে)। ছবি: ইউসুফ সা’দ
আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের জন্য গৌরব বয়ে আনা তরুণদের গল্প শুনছেন জামিলুর রেজা চৌধুরী (ডানে)। ছবি: ইউসুফ সা’দ

আমরা প্রথম থেকেই শুধু প্রতিযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে গণিত যে একটি আনন্দের বিষয় হতে পারে, সে দিকটি তুলে ধরার জন্য প্রতিযোগিতার বাইরে কিছু আয়োজনের চিন্তাভাবনা করি এবং সে লক্ষ্যে নামকরণ করা হয় ‘জাতীয় গণিত উৎসব’। আমাদের সৌভাগ্য, দেশব্যাপী এ বিরাট আয়োজনে প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্য ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার জন্য এগিয়ে আসেন। আমার মনে হলো, ওঁদের একটা নাম দেওয়া উচিত আর আমি গণিত অলিম্পিয়াডে স্বেচ্ছাসেবকদের নাম দিই ম্যাথ অলিম্পিয়াড ভলান্টিয়ার্স (মুভার্স)। যেহেতু ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এবং প্রথম আলো সব সময় সাহায্য করছিল, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিই এর নামকরণ হবে ‘ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসব’।

আইএমওতে অংশগ্রহণের পূর্বশর্ত হলো আইএমওর সদস্যপদ লাভ করা। এ জন্য ২০০৪ সালে আমাদের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসানকে গ্রিসের এথেন্সে অনুষ্ঠিত আইএমওতে পাঠাই। তত দিনে আমরা দুটি জাতীয় অলিম্পিয়াড সম্পন্ন করেছি। আইএমওর সদস্যপদের দরখাস্ত আইএমও কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করে। যার ফলে আমরা ২০০৫ সালে প্রথমবারের মতো মেক্সিকোতে আমাদের গণিত দল পাঠাতে সক্ষম হই। জাতীয় দল নির্বাচনে যে পদ্ধতিটি আমরা অনুসরণ করি জাতীয় পর্যায়ে ঢাকায় যে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি পর্যায়ে যারা ভালো ফলাফল অর্জন করে, তাদের মধ্য থেকে একটি ক্যাম্প করে এবং কয়েকটি নির্বাচনী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চূড়ান্ত দল গঠন করা হয়।

আমি ২০০৪ সালে নটর ডেম কলেজে অনুষ্ঠিত জাতীয় গণিত উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রতিযোগীদের কাছে আমার তিনটি স্বপ্নের কথা বলি। প্রথমটি হলো ২০১০ সালে মধ্যে আইএমও পদক অর্জন, ২০২২ সালের মধ্যে গণিতবিদদের জন্য তখনকার সর্বোচ্চ পুরস্কার ফিল্ডস পদক অর্জন এবং তৃতীয়টি হলো ২০৩০ সালের মধ্যে বিজ্ঞানের কোনো একটি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার অর্জন। প্রথম কয়েকটি আইএমওতে অংশগ্রহণ করে আমাদের প্রতিযোগীদের দলনেতা, উপদলনেতাদের জন্য ছিল মূলত অভিজ্ঞতা আহরণের সুযোগ। আমাদের সৌভাগ্য, কয়েক বছরের মধ্যেই প্রতিভাবান তরুণ বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ মাহবুব মজুমদার দেশে ফিরে আসেন এবং আমাদের গণিত দলের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিতে সম্মত হন। এরপর প্রতিটি আইএমওতে আমাদের দল অংশ নিয়েছে এবং ধীরে ধীরে আমাদের দলের সামগ্রিক উন্নতি হয়। আমাদের প্রথম লক্ষ্য যেটা ছিল, সেটা আমরা ২০০৯ সালেই অর্জন করি। প্রতিটি আইএমওতে দলনেতা হিসেবে মাহবুব মজুমদার এবং উপদলনেতা মুনির হাসান থাকায় প্রতিযোগীদের মনোবল বাড়ানোর ক্ষেত্রে বেশ সহায়তা করেছে। যারা আইএমওতে বিভিন্ন সময় পদক অর্জন এবং ভালো করেছে, তারা এখন বিশ্বসেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর বিষয়ে পড়াশোনা করছে। এটা দারুণ এক অর্জন। এখন আমাদের শিক্ষকদের মধ্যেও অনেক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। অভিভাবকেরাও অনেক উৎসাহী। আমরা গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির পক্ষ থেকে দেশের বাইরে থেকে বিভিন্ন বই দেশে এনে পুনর্মুদ্রণ করেছি, যা শিক্ষার্থীদের বেশ কাজে লাগছে।

জামিলুর রেজা চৌধুরী: সভাপতি, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি