মনস্তাত্ত্বিক সংকটে পুলিশের একাংশ

অপরাধের ধরন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশি ব্যবস্থায় যথাযোগ্য পরিবর্তন না আসার কারণে সন্ত্রাসী আক্রমণ প্রতিরোধ ও তদন্তের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না পুলিশ। সময়োপযোগী সংস্কারের মাধ্যমে এ থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, বাহিনীর একটি বড় অংশ এখন মনস্তাত্ত্বিক সংকটে আছে। যে কারণে মাঠপর্যায়ে তাদের সক্রিয় থাকতে দেখা যাচ্ছে না।
সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের নিয়োগ নিয়ে নানা অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব ও ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগের অভিযোগ আছে। তাই ঘুষ দিয়ে চাকরিতে আসা তরুণ পুলিশ সদস্যরা নিজেদের বিনিয়োগ ওঠানো নিয়েই বেশি চিন্তিত। মাঠপর্যায়ে কাজের ক্ষেত্রে তাঁরা কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে নারাজ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গত বৃহস্পতিবার বিবিসিকে বলেছেন, আশুলিয়ায় চেকপোস্টে দায়িত্বরত সব পুলিশ সদস্যই ছিলেন নবীন। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নতুন ও পুরোনো সদস্যদের মিলিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে পুলিশ।
তারপরও অনেকে বলেছেন, গত ছয়-সাত বছরে পুলিশে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। নতুন নতুন অনেক ইউনিট গঠন করা হয়েছে। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মানসিকতা ও চিন্তাধারায়ও পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে যাঁরা জড়িত, পুলিশের নিম্ন পর্যায়ের সেসব সদস্যের মানসিকতা, কাজের ধরনে সে রকম পরিবর্তন আসেনি। এঁরাই পুলিশের বড় অংশ। ফলে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণসহ নানা অভিজ্ঞতা প্রয়োগের পরিবর্তে নিজেদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থেকে যায়।
গত বুধবার আশুলিয়ার বাড়ইপাড়ায় দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন শিল্প পুলিশের কনস্টেবল মুকুল হোসেন। আহত হন আরেকজন। দুই হামলাকারীর ছুরি-চাপাতির মুখে কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারেননি সশস্ত্র পুলিশ সদস্যরা। অথচ পাঁচজনের হাতেই পাঁচটি চায়নিজ রাইফেল ছিল। তারপরও কেউ গুলি ছোড়েননি। দুই কনস্টেবল হামলার শিকার হওয়ার পরে সেখানে উপস্থিত অন্য তিনজন শালবনের দিকে দৌড় দেন। হাতে অস্ত্র থাকার পরও কেন তাঁরা গুলি ছুড়লেন না, সে প্রশ্নের কোনো উত্তর পাচ্ছেন না পুলিশ কর্মকর্তারা।
২০১৩ সালের ১ এপ্রিল রাজশাহীর শালবাগান বাজারে জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র কর্মীরা হামলা চালায় পুলিশের ওপর। ওই বাজারের পাশে দায়িত্ব পালন করছিলেন উপশহর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলমসহ পুলিশের ১০ সদস্য। তাঁরা ককটেলের শব্দ পেয়ে এগিয়ে গেলে শিবিরকর্মীরা সশস্ত্র অবস্থায় তাঁদের ধাওয়া করে। এ সময় পুলিশের অন্য সদস্যরা সেখান থেকে পালিয়ে গেলেও জাহাঙ্গীর শিবিরকর্মীদের আক্রমণের শিকার হন। শিবিরকর্মীরা নৃশংসভাবে ইট ও হেলমেট দিয়ে আঘাত করতে থাকে জাহাঙ্গীরকে। শিবিরকর্মীরা জাহাঙ্গীর আলমকে গুরুতর জখম করে রাস্তায় ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের একটি পিস্তল নিয়ে যায়। জাহাঙ্গীর আলমকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে ঝর্না বেগম নামের এক নারী এসে তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন।
এদিকে গত ২২ অক্টোবর রাজধানীর গাবতলীতে এক ব্যক্তির ব্যাগ তল্লাশির সময় দারুস সালাম থানার এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে ছুরি মেরে খুন করা হয়। অবশ্য ওই সময় তাঁর সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে গিয়ে আক্রমণকারীকে ধরে ফেলেন। মাসুদ রানা নামের সেই যুবককে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
এর আগে ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, প্রতিবছর পুলিশের ২৫-৩০ জন কর্মকর্তা বিদেশে পড়তে যান। যাঁদের অর্ধেকেরই পড়ার বিষয় থাকে ‘কাউন্টার টেররিজম’ বা এ-সংশ্লিষ্ট বিষয়। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিষয়ে অনেকেই পিএইচডি নিয়েছেন। তবে দেশে ফিরে তাঁরা সে কাজে নিযুক্ত হচ্ছেন না। মাঠপর্যায়ে কাজে লাগছে না তাঁদের বিদ্যা। কারণ, তাঁদের সে বিদ্যা কাজে লাগানোর প্ল্যাটফর্ম নেই।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক ও পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক আবদুল হান্নান খান বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য যদি দায়িত্ব পালনের সময় পালিয়ে যান, সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পুলিশকে যে অস্ত্র দেওয়া হয়, সেটা দেখানোর জন্য নয়। আগে দৃশ্যমান হলেই মানুষ ভয় পেত। এখন আর সেটা নেই। অপরাধীদের সক্ষমতাও বেড়েছে। সময়ও পাল্টে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক নাগরিকেরই যেমন জানমাল রক্ষার অধিকার রয়েছে, পুলিশেরও রয়েছে। তবে পুলিশের ভূমিকা আরও ব্যাপক। নিজেদের রক্ষার পাশাপাশি নাগরিকদের জানমাল রক্ষার দায়িত্বও তাদের। আক্রমণের শিকার হলে প্রতিরোধ করতে হবে। তাদের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে, সময়ের উপযোগী করে বাহিনীকে গড়ে তুলতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমানও বললেন, সমাজ পরিবর্তনের কারণে অপরাধের ধরনে যে পরিবর্তন হয়েছে, সে তুলনায় পুলিশের সক্ষমতা সেভাবে বাড়েনি। নিচের পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা সনাতনি কাঠামোতে পরিচালিত হওয়ায় তাঁদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো নিয়েও কাজ হয়নি। এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
অধ্যাপক জিয়া রহমান মনে করেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে দেশীয় যোগাযোগ বাড়ার কারণে অপরাধীরা নিত্যনতুন ধরনের অপরাধ করছে। কিন্তু পুলিশের বেশির ভাগ সদস্যই কাজ করছেন পুরোনো ধারায়। সে ধারা থেকে বেরিয়ে এসে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, মানসিক দৃঢ়তা, দক্ষতা এবং দেশপ্রেমের বলে বলীয়ান করে কাজে লাগাতে না পারলে এই সময়ে অপরাধ দমন ও প্রতিরোধ কঠিন হয়ে পড়বে। তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সংস্কারে মনোযোগী হতে হবে।
সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাদেকা হালিম মনে করেন, পুলিশের ওপর যেসব হামলা হচ্ছে, আক্রান্ত সদস্যরা এর জন্য তৈরি নন। তাঁরা ভাবতেও পারেন না, সাধারণ সময়ে তাঁদের ওপর এ ধরনের হামলা হতে পারে। তাঁরা হকচকিত হয়ে যান।