বিদায়বেলার বেদনা

ভারতে চলে যাচ্ছে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহলের ৩১টি পরিবার। একটি পরিবারের বিক্রি করে দেওয়া বাঁশ কেটে নেওয়া হচ্ছে। ছবিটি গত শুক্রবার জোংড়া ইউনিয়নের বাঁশকাটার বর্মণপাড়া ​থেকে তোলা l প্রথম আলো
ভারতে চলে যাচ্ছে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহলের ৩১টি পরিবার। একটি পরিবারের বিক্রি করে দেওয়া বাঁশ কেটে নেওয়া হচ্ছে। ছবিটি গত শুক্রবার জোংড়া ইউনিয়নের বাঁশকাটার বর্মণপাড়া ​থেকে তোলা l প্রথম আলো

বাপ-দাদার জমি ছেড়ে যেতে মন চায় না। তবু যেতে হবে। কারণ, অনেকেই ভারতে যাওয়ার জন্য নাম লিখিয়েছে। কেউ কেউ যাচ্ছে স্বজনেরা সেখানে আছে বলে।
তারা লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দুটি ইউনিয়নের মধ্যে থাকা পাঁচটি বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দা। এখানকার ১৩৩ জন জমিজমা বিক্রি করে ভারতে চলে যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছে। এ মাসেই তাদের বাংলাদেশ ছাড়তে হতে পারে।
এদিকে পরিবারের অংশ হয়ে ওঠা দীর্ঘদিনের প্রতিবেশীদের বিদায়বেলায় বেদনা ভর করেছে অন্য বাসিন্দাদের।
উপজেলার দুটি ইউনিয়নের ভেতরে থাকা সদ্যবিলুপ্ত ১১২, ১১৫ ও ১১৯ বাঁশকাটা, ১১৪ লতামারী ও ১১৫ খড়খড়িয়া ছিটমহলের ৩১ পরিবারের ১৩৩ নারী-পুরুষ ও শিশু ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছে।
গত শনিবার সরেজমিনে বাঁশকাটার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জমিজমা বিক্রি করে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে বর্মণপাড়ার ২১ পরিবারের ৯৯ জন নারী-পুরুষ ও শিশু। এরই মধ্যে গাছপালা ও গবাদিপশু বিক্রি করে দিয়েছে তারা। বাঁশঝাড় বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি বাঁশঝাড়ের বাঁশ শিকড়সহ উপড়ে নিয়ে যাচ্ছে ক্রেতারা। সেখানে একটি মন্দিরের ৩ শতাংশ জমিও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ওই মন্দিরের টিনের ঘর ও প্রতিমা সরিয়ে নেওয়া হবে।
ওই মন্দির ও গ্রামের মাটি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন বলে জানালেন প্রতিমা বর্মণ। তিনি বলেন, ‘বাপ-দাদার বাড়িঘর জায়গা-জমি ছেড়ে কি কারও থাকতে মন চায়? তবু যে যেতে হবে আমাদের। কারণ, ওপারে (ভারত) যাওয়ার জন্য নাম লিখিয়েছি।’
একই গ্রামের অশ্বিনী কুমার বর্মণের কাছে ভারতে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘ধরলা নদী শুধু বাড়ি ভেঙে নিয়ে যায়নি, নদী আমাদের গিলে খাচ্ছে। এ পর্যন্ত পাঁচবার বসতবাড়ি গড়তে হয়েছে। জমিজমা সবই নদীগর্ভে গেছে। এ ছাড়া আমার এক ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে বড় দুই মেয়েরই ভারতের ধুবগুড়ি ও জামালদায় বিয়ে দিয়েছি। অনেক আগে বাপ-দাদাসহ আত্মীয়স্বজনেরা ভারতে গেছেন। তাই আমরাও এখন ভারতে চলে যাচ্ছি।’ একই কথা বলেন ওই ছিটমহলের জয়ন্তী বালা, শষী বালা ও গঙ্গা চন্দ্র বর্মণ।
জোংড়া ন্যাশনাল উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সুচরিতা রানী বলে, সে এখানে থাকতে চায়। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে তাকেও ওপারে যেতে হচ্ছে।
বাঁশকাটার দোয়ালেরটারী গ্রামের প্রতিবেশী মজিবর রহমান বলেন, ‘এতে তো হামার মনোত বড় কষ্ট লাগছে বাহে। এতাদিন মিলেমিশে ছিন হামারা। ওমরা গেইলে এলা গ্রামটা ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। ওই সড়ক দিয়া গেইলে বুকটা ফাঁকা নাগে।’
জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ৫ ও ৯ নভেম্বর এসব পরিবারের ভারতে যাওয়া কথা ছিল। কিন্তু পরে তা স্থগিত করা হয়। তবে এ মাসেরই যেকোনো দিন উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দরের অভিবাসন পথ অতিক্রম করে তারা ভারতে প্রবেশ করবে। এরপর ভারতের কোচবিহার জেলার মেকলিগঞ্জ মহকুমার সদর থানা এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্রে যাবে। প্রথম দিনে ভারতে যাবে ১০ পরিবারের ৩৪ জন। শেষ দফায় বাংলাদেশ ছাড়বে ২১ পরিবারের ৯৯ জন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূর কুতুবুল আলম বলেন, ভারতীয়দের প্রস্তুতি শেষ না হওয়ায় তাঁরা সময় পিছিয়েছেন। তবে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে যাওয়ার দিন নির্ধারণ হবে বলে আশা করা যায়।