নয়নের মায়ের নয়নে বাঁধভাঙা অশ্রু

নয়ন বাছার
নয়ন বাছার

নয়ন বাছার। হিন্দু সম্প্রদায়ের ‘বাছার’ বংশের এই ছেলেকে পুলিশ ধরে নেয় ‘নয়ন বাশার’ বলে। বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় তাঁকে শিবিরের কর্মী হিসেবে পাকাড়াও করে তারা। আগুন দেওয়ার অভিযোগ তুলে একপর্যায়ে তাঁর পায়ে গুলি করা হয়। এ ঘটনায় নয়নের বিরুদ্ধে থানায় মামলাও হয়েছে। পরে গণমাধ্যম এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জামিন হয় নয়নের।
জামিন পেলেও স্বস্তি মেলেনি নয়নের ও তাঁর পরিবারের। পায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে এখন নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়েছে হতদরিদ্র পরিবারটি। একই সঙ্গে রয়েছে মামলার হয়রানি। গতকাল সোমবার প্রথম আলো কার্যালয়ে এসে এসব কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নয়নের মা শিখা রানী। সে বাঁধভাঙা কান্না যে কারও হৃদয়ে নাড়া দেবে। মায়ের কণ্ঠে ব্যাকুলতা, ‘আমার নয়ন কি স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে?’
নয়ন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। রাজধানীর দয়াগঞ্জে একটি মেসে থেকে পড়াশোনা করতেন তিনি। নয়নের ভাষ্য, গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বাসে চড়ে ছাত্র পড়াতে যাচ্ছিলেন তিনি। কিছু দূর গেলে কে বা কারা বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে নেমে দৌড় দেন তিনি। কোতোয়ালি থানার পুলিশ তাঁকে ধরে ফেলে। পুলিশ বলে, ‘তুই শিবির করস, তুই আগুন দিছস!’
নয়ন পুলিশকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের, নাম নয়ন বাছার। পুলিশ বলে, ‘নয়ন বাশার কোনো হিন্দুর নাম হইল?’ এ বলে পুলিশ কিছু দূর নিয়ে গিয়ে তাঁর বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপর গুলি করে।
পরে কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) এরশাদ হোসেন বাদী হয়ে নয়নের বিরুদ্ধে সূত্রাপুর থানায় একটি মামলা করেন। পুলিশ নয়নের পায়ে গুলি করার অভিযোগ অস্বীকার করে। পুলিশের ভাষ্য, আগুন ধরিয়ে দুষ্কৃতকারীরা পালানোর চেষ্টা করে। নয়ন পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ছোড়ার চেষ্টা চালায়। তখন শটগান দিয়ে গুলি করা হলে গুলি তাঁর পায়ে লাগে।
পরে পুলিশ অবশ্য বলেছে, তারা শুনেছে নয়ন বিএনপির কর্মী।
ঘটনার পর পুলিশ পাহারায় রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে নয়নের চিকিৎসা চলে। গত ১৭ মে নয়নের জামিন হয়।

নয়ন বাছারের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের গোবিন্দপুরে। মায়ের একমাত্র সন্তান তিনি। তাঁর বয়স যখন ছয় মাস, তখন তাঁর বাবা ভারতে চলে যান। আর ফেরেননি। গোবিন্দপুরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে সংসারের হাল ধরেন মা শিখা রানী। স্কুল ও কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ছেলে নয়নকে ভর্তি করান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মায়ের পাঠানো টাকা আর ছাত্র পড়ানোর টাকায় চলছিল নয়নের পড়াশোনা।
হঠাৎ ছেলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় ছুটে আসেন মা শিখা। তিন মাস তিনি হাসপাতালে ছেলের সঙ্গেই ছিলেন। জামিনের পর ছেলের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্য খুঁজে বেড়িয়েছেন। একটি ব্যাংক থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও মোরেলগঞ্জ উপজেলার শিক্ষক সমিতি ও একজন পুলিশ কর্মকর্তার দেওয়া টাকা দিয়ে নয়নকে নিয়ে গেছেন ভারতের চেন্নাইয়ের এক হাসপাতালে। সেখানে অস্ত্রোপচার করা হয়। দেশে ফিরে এখনো ছেলের ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় আছেন শিখা রানী।
শিখা রানী বলেন, ‘মাস্টারি করে পাই ১২ হাজার টাকা। আট হাজার টাকা ঋণ বাবদ ব্যাংকে দিতে হয়। এবার বোঝেন, চার হাজার টাকায় সংসারটা কীভাবে চালাই! আবার নয়নকে ভারতে নিয়ে যেতে হবে। আবার অস্ত্রোপচার করতে হবে। কিন্তু আমার কাছে কোনো টাকা নেই। জানি না, কী করব?’ শিখা রানী বলেন, ‘একদিকে ছেলের পা, আরেকদিকে ছেলের কাঁধে মামলা। সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকি।’
মোবাইল ফোনে নয়ন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি জীবনে কোনো দিন রাজনীতি করিনি। আমি আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে টেনশনে আছি।’
এ ব্যাপারে মামলার সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রাপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আমানুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটি ডিবি তদন্ত করছে।
আপনার তদন্তে আগুন দেওয়ার ওই ঘটনায় নয়ন জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে কি না—প্রশ্ন করলে আমানুল্লাহ বলেন, ‘এটা বাদী বলতে পারবে। আমি তো আইও (তদন্ত কর্মকর্তা)। তদন্ত শেষ করতে পারিনি।’
জানা গেছে, মামলার বাদী কোতোয়ালি থানার এসআই এরশাদ বর্তমানে ডিবিতে কর্মরত। কোতোয়ালি থানা থেকে তাঁর কোনো মোবাইল নম্বর পাওয়া যায়নি।
নয়নের আইনজীবী দেব দুলাল দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ এখনো আদালতে কোনো প্রতিবেদন দেয়নি।’
শিখা রানী কাঁদতে কাঁদতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক সংগ্রাম করে ছেলেটাকে মানুষ করার চেষ্টা করেছি। জানি না, আমার ভাগ্যে এমনটা লেখা ছিল কেন?

’অারও পড়ুন:-