রিভিউ আবেদন খারিজ, রায় বহাল

.
.

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইতিমধ্যে দুজনের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। সেই বিচার আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের শাস্তি দিয়ে কলঙ্কমোচনের পথে এগিয়ে গেল দেশও। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এখন তাঁদের শাস্তি একরকম নিশ্চিত, যদি না রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির সাজা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ। গতকাল বুধবার সে আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফলে এই দুই মানবতাবিরোধী অপরাধীর ফাঁসির সাজা বহাল থাকল।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ গতকাল বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে দুটি আবেদনই খারিজ করে আদেশ দেন। আদেশের সময় প্রধান বিচারপতি শুধু বলেন, ‘ডিসমিসড...ডিসমিসড।’ এ বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
প্রায় পাঁচ বছরের দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে গতকাল আপিল বিভাগের এ আদেশের মধ্য দিয়ে শেষ হলো সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার কার্যক্রম। প্রাণভিক্ষার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই তাঁদের সামনে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে কীভাবে দণ্ড কার্যকর হবে, তা বিস্তারিত বলা আছে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার পুনর্বিবেচনার আবেদনের রায়ে। আপিল বিভাগের ওই রায় অনুসারে, আদালতের আদেশ পাওয়ার পর কারা কর্তৃপক্ষকে আসামির সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্যদের দেখা করার সুযোগ দিতে হবে। আর কারা কর্তৃপক্ষ আসামির কাছে জানতে চাইবে, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন করবেন কি না। যদি আসামি ক্ষমার আবেদন করতে না চান, তবে কারা কর্তৃপক্ষের উচিত দেরি না করে দণ্ড কার্যকর করা। তবে জেলকোডের ৯৯১ বিধি অনুসারে ৭ বা ২১ দিনে দণ্ড কার্যকরের নিয়ম এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
এই দুই অপরাধীর রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। সকাল থেকে সুপ্রিম কোর্ট ও সংলগ্ন এলাকায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আদালতে ঢোকার সময় পরিচয়পত্র পরীক্ষা বা তল্লাশি করে পুলিশ।
মুক্তিযুদ্ধের পর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দেশ ছেড়ে পালান। তাঁর দাবি, ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে তিনি দেশে ফেরেন। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর পাল্টে যায় দেশের রাজনৈতিক চালচিত্র। দেশে ফেরার পর তিনি বারবার দল বদলে ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেছেন। একপর্যায়ে স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন সাকা চৌধুরী। সবশেষে তিনি যোগ দেন বিএনপিতে। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের (২০০১-২০০৬) প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ-বিষয়ক উপদেষ্টাও হন। বর্তমানে তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য।
মুক্তিযুদ্ধের পর আলবদর নেতা মুজাহিদ ছিলেন আত্মগোপনে। জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পেলে মুজাহিদসহ অন্য নেতারা সামনে আসেন। তিনি এখনো জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল। ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধে জামায়াত। জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া মুজাহিদকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে করা মামলার রায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন, মানবসভ্যতার সম্মিলিত বিবেককে কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো ঘৃণ্যতম অপরাধ করেছেন এই আসামি। এ জন্য তাঁকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হবে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, আদালতে তাঁর আচরণ ভালো ব্যবহারের পরিচয় বহন করেনি।
আর একাত্তরে বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিকল্পনা ও সহযোগিতা করার জন্য জামায়াত নেতা মুজাহিদ কীভাবে দায়ী, তার ব্যাখ্যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাঁর রায়ে বলেছিলেন, একাত্তরে ছাত্রসংঘের সদস্যরা আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। মুজাহিদ ছাত্রসংঘের ঊর্ধ্বতন নেতা ছিলেন। ক্ষমতাধারী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে আলবদর গঠন থেকে শুরু করে হত্যা-নিধনযজ্ঞের শেষ পর্যন্ত এই বাহিনীর ওপর তাঁর কর্তৃত্ব ছিল।
২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে মুজাহিদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। অতীতেও কোনো যুদ্ধাপরাধী ছিল না।’ কিন্তু ট্রাইব্যুনাল থেকে গতকাল পর্যন্ত সব কটি রায়ে তিনি নিজেই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ও দণ্ডিত হলেন।
গতকাল আপিল বিভাগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের ওপর শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। শুনানি শেষে আদালত বেলা সাড়ে ১১টায় আদেশ দেবেন বলে জানান। মুজাহিদের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের ওপর আদেশের সময় আগে থেকেই বেলা সাড়ে ১১টায় ধার্য ছিল। গত মঙ্গলবার ওই আবেদনের শুনানি শেষ হয়।
চূড়ান্ত রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হওয়ার মাধ্যমে সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ হলো। দণ্ড কার্যকরে আর কোনো আইনি বাধা নেই। কারা কর্তৃপক্ষ সরকারের সিদ্ধান্তে সাজা কার্যকর করবে। অবশ্য যদি তাঁরা রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চান, তাহলে আলাদা বিষয়।
কত দিনের মধ্যে দণ্ড কার্যকর হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে নির্দিষ্ট করে কোনো সময় দেওয়া নেই। এ ক্ষেত্রে জেলকোড প্রযোজ্য হবে না। সরকারের সিদ্ধান্তে সাজা কার্যকর হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘একাত্তরের ১৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বর তিন দিনে যত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে, তা বিশ্বের আর কোথাও হয়নি। বুদ্ধিজীবীদের কথা মনে পড়লে মন বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য যদি কোনো বিচারের রায় না পেতাম, আমাদের হতাশাটা অব্যাহত থাকত। একজনকেও (মুজাহিদ) যে সাজা দেওয়া হলো, সেটাই আমাদের স্বস্তি, সান্ত্বনা।’ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তাঁর (সাকা চৌধুরী) অপরাধ অভাবনীয়। আর কোনো আসামিকে চারটি অভিযোগের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। এমন ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েও যদি তিনি ছাড়া পেয়ে যেতেন, তাহলে সেটা হতো বিরাট পরাজয়।
রায়ের পর আসামিদের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘একজন আইনজীবী অপরাধকে সমর্থন করেন না। আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন, তা সঠিক মনে করেই দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমাদের কোনো ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া নেই।’ সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ তাঁদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এখানে আমার কিছু বলার নেই।’
মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন কি না, জানতে চাইলে তাঁর ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে এ বিষয়ে জানতে পারব।’
রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজের পর গতকাল বিকেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়। মুজাহিদ আগে থেকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। সন্ধ্যায় কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-প্রিজনস) গোলাম হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, দুজনকেই কনডেমড সেলে রাখা হয়েছে। তবে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজের আদেশ এখনো কারাগারে পৌঁছায়নি।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার: ৫ বছরে বিচার শেষ
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী

২০১০, ১৬ ডিসেম্বর
সাকা চৌধুরী গ্রেপ্তার
২০১১, ১৪ নভেম্বর
অভিযোগ দাখিল
২০১২, ৪ এপ্রিল
২৩ অভিযোগ গঠন
২০১৩, ১ অক্টোবর
ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির রায়
২০১৫, ২৯ জুলাই
ফাঁসির রায় আপিলে বহাল
২০১৫, ১৮ নভেম্বর
পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ

কোন অভিযোগে কী সাজা
১. মধ্য গহিরা গণহত্যা ২০ বছর
২. নূতনচন্দ্র সিংহ হত্যা ফাঁসি
৩. জগৎমল্লপাড়া গণহত্যা ২০ বছর
৪. সুলতানপুর বণিকপাড়ায় গণহত্যা ফাঁসি
৫. ঊনসত্তরপাড়ায় গণহত্যা ফাঁসি
৬. মোজাফফর ও আলমগীরকে হত্যা ফাঁসি
৭. নিজামউদ্দিনকে নির্যাতন ৫ বছর
৮. সালেহউদ্দিনকে নির্যাতন ৫ বছর

আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ
আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ

আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ
২০১০, ২৯ জুন
মুজাহিদ গ্রেপ্তার
২০১২, ১৬ জানুয়ারি
অভিযোগ দাখিল
২০১২, ২১ জুন
৭ অভিযোগ গঠন
২০১৩, ১৭ জুলাই
ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায়
২০১৫, ১৬ জুন
ফাঁসির রায় আপিলে বহাল
২০১৫, ১৮ নভেম্বর
পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ

কোন অভিযোগে কী সাজা
১. ফরিদপুরের রণজিৎ নাথকে নির্যাতন ৫ বছর
২. বদি, রুমীদের হত্যায় প্ররোচনা যাবজ্জীবন
৩. বুদ্ধিজীবী নিধনের ষড়যন্ত্র ও সহযোগিতা ফাঁসি
৪. ফরিদপুরের বাকচর গ্রামে হত্যা ও নিপীড়ন যাবজ্জীবন

বাকি শুধু প্রাণভিক্ষা
প্রাণ বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ পাবেন