শরিকেরা সুযোগ চায়, একক প্রার্থী নিয়েই হিমশিম আ.লীগ

১৪-দলীয় জোটের প্রধান অংশীদার আওয়ামী লীগ আলাদাভাবে পৌরসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে জোটের শরিক দলগুলো সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচন করার চেষ্টা করছে। এই লক্ষ্যে একটি বৈঠকে বসার জন্য কয়েকটি শরিক আওয়ামী লীগের কাছে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রত্যাশিত সাড়া তারা পায়নি।
আওয়ামী লীগের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের প্রার্থী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতৃত্ব হিমশিম খাচ্ছে। আগামীকাল সোমবারের মধ্যে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের মনোনয়ন বোর্ডের মাধ্যমে একক প্রার্থী নির্বাচন করে দলীয় সভানেত্রীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে পাঠানোর নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত কোনো প্রার্থীর তালিকা আসেনি। তৃণমূল নেতৃত্ব অধিকাংশ পৌরসভারই একক প্রার্থী ঠিক করতে পারছে না বলে খবর আসছে।
এই নেতারা বলছেন, এ অবস্থায় ১৪ দলের সঙ্গে সমঝোতা করা তো কঠিন। আর নিকট-অতীতে ১৪ দলের শরিকদের কারও প্রার্থী পৌর নির্বাচনে জয়ী হওয়ার রেকর্ড নেই। ফলে জোটগত নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগের কোনো লাভ নেই। তারপরও এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা ১৪ দলের প্রধান ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার মনোভাব জানার চেষ্টা করছেন। তাঁর ইতি বাচক মতামত পেলে প্রয়োজনে ১৪ দলের বৈঠকও হতে পারে।
১৪ দলের একাধিক শরিক প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৃহস্পতিবারের বৈঠকে এককভাবে নির্বাচনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। এরপরও তাঁরা চাইছেন একটা বৈঠকের মাধ্যমে যেন আওয়ামী লীগ অবস্থান পরিষ্কার করে। গতকাল একটা বৈঠক হওয়ার কথাও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি।
১৪ দল সূত্র জানায়, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন তাঁর দলের জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন এমন ছয়-সাতজন প্রার্থীর বিষয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে জোটের মুখপাত্র আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। জাসদের পক্ষ থেকেও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ করা হয়েছে। অন্য শরিকেরা নিজেরা বসে কথা বলেছেন। তবে সবার বক্তব্য হলো, ১৪ দলের বৈঠক হলে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচন এবং কার কোন পৌরসভায় ভালো প্রার্থী আছে তা তুলে ধরে একটা জায়গায় পৌঁছানো যেত।
জানতে চাইলে মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ১৪ দলের শরিকেরাও যোগাযোগ করছেন। কোথায় কার সম্ভাবনা আছে সেগুলো বলছেন তাঁরা। তবে সময় খুব কম। দলের সভানেত্রীর সঙ্গে কথা বলে একটা সমাধানে আসার চেষ্টা করা হবে। তবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করলেও শরিকদের কোনো খেদ থাকবে না।
১৪ দলের শরিকদের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন করলে ১৪ দলেরও ভাবা উচিত। ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন না হলেও কৌশলে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। যেমন কেন্দ্রীয়ভাবে সম্ভব না হলে জয়ী হতে পারেন এমন শরিক দলের প্রার্থীর বেলায় আওয়ামী লীগ থেকে ছাড় দেওয়া যেতে পারে। নতুবা অনেক স্থানে ১৪ দলের শরিকেরা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যাবেন। এর সুফল নেবে ২০-দলীয় জোট।
জানতে চাইলে তথ্যমন্ত্রী ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, তাঁর দল এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্থানীয় নেতাদের সেভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে জোটগতভাবে নির্বাচন করার বিষয়েও আলোচনা চলছে। শেষ পর্যন্ত যেভাবেই হোক, প্রস্তুতি রয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, দেশের সব পৌরসভায় আওয়ামী লীগের শক্ত প্রার্থী রয়েছেন। শেষ মুহূর্তে এসে জোটগতভাবে নির্বাচনের চেষ্টা করলে তৃণমূল সামাল দেওয়া কঠিন হবে। এটা বাস্তবসম্মতও নয়। তবে তৃণমূল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড যদি মনে করে, কোথাও শরিকদের দলের ভালো প্রার্থী রয়েছে, জয়ের স্বার্থে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া প্রয়োজন, তাহলে তা দলীয় প্রধানের দৃষ্টিগোচর করা যেতে পারে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ভার তাঁর ওপর ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত জোটগতভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেই। হওয়ার সম্ভাবনাও কম।
জানতে চাইলে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘পৌরসভা নির্বাচন জোটগতভাবে না এককভাবে করা হবে, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তাই যেসব এলাকায় সাংগঠনিক অবস্থা ভালো, সেসব এলাকায় আমাদের প্রার্থী দেওয়া হবে।’
আর গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক নূরুর রহমান সেলিম বলেন, কিশোরগঞ্জ, নোয়াখালী ও কুষ্টিয়ায় তাঁর দলের সম্ভাবনাময় প্রার্থী রয়েছেন। সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন হলে ভালো হতো। তা না হলে কিছু কিছু স্থানে জোটের প্রার্থী একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে। বিষয়গুলো খোলাসা করার জন্য ১৪ দলের একটি বৈঠক হওয়া জরুরি।
কোন্দল ঠেকাতে শেখ হাসিনার সইয়ে মনোনয়ন: মেয়র পদে একক প্রার্থী মনোনয়নের জন্য আওয়ামী লীগ জেলা, উপজেলা ও পৌরসভার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে বোর্ড গঠন করে দিয়েছে। স্থানীয় সাংসদের পরামর্শে একক প্রার্থী মনোনয়ন করে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অন্তত পাঁচটি জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৃণমূল বোর্ড অধিকাংশ পৌরসভাতেই একক প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারছে না। তাই তারা তিনের অধিক প্রার্থী ঠিক করে তাদের রাজনৈতিক জীবনবৃত্তান্তসহ কেন্দ্রে পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।
একটি জেলার সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিনজনের কম নাম পাঠাতে গেলে সব সদস্য সই করবেন না। কিছু কিছু পৌরসভায় পাঁচ-সাতজনেরও নাম যাবে। ওই নেতা বলেন, ‘আমরা বড়জোর এক নম্বরে কে থাকবে আর দুই-তিন নম্বরে নাম কার থাকবে সেটা ঠিক করতে পারি। সব পৌরসভার জন্য একজনের নাম পাঠানো খুবই কঠিন।’
রাজশাহী জেলায় এবার ১৩টি পৌরসভার নির্বাচন হবে। এখন পর্যন্ত কাকনহাট ও তাহেরপুরে একক প্রার্থী ঠিক করা গেছে। এই দুই পৌরসভায় আওয়ামী লীগের দুই বর্তমান মেয়রকেই প্রার্থী হিসেবে পাঠানো হবে।
জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ১১টি পৌরসভায় একক প্রার্থী মনোনয়নে চেষ্টা চলছে। একান্ত না পারলে একাধিক প্রার্থীর নাম পাঠানো হবে।
ময়মনসিংহের নয়টি পৌরসভায় নির্বাচন হবে। ওই জেলার একজন নেতা জানান, একটিতেও একক প্রার্থী ঠিক করা যায়নি।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, প্রার্থীর জন্য দলীয় সভানেত্রী সই করে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেবেন—এই কথা শোনার পর তৃণমূল থেকে একাধিক প্রার্থী প্রস্তাব করার তোড়জোড় শুরু হয়। এখন স্থানীয় সাংসদেরাও খবরদারি করতে সংকোচ বোধ করছেন। সাংগঠনিক সম্পাদকেরাও হস্তক্ষেপ কমাচ্ছেন।
ওই নেতা দাবি করেন, দলীয় সভানেত্রীর কাছে সারা দেশের সম্ভাব্য প্রার্থীদের গোয়েন্দা প্রতিবেদন আছে। তিনি নিজেও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রার্থীদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে রেখেছেন। ফলে যেসব এলাকায় একক প্রার্থী ঠিক করা যাবে, সেগুলো অনুমোদন করে দেওয়া হবে। একাধিক প্রার্থীর ক্ষেত্রে গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও দলীয় সভানেত্রীর নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে।
আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, দলীয় সভানেত্রী নিজের সইয়ে প্রার্থীর নাম নির্বাচন কমিশনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কয়েকটি বিবেচনা থেকে। প্রথমত. প্রধানমন্ত্রী নিজে সই করবেন বলে মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নেওয়ার সাহস পাবেন না। তাহলে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের শাস্তি পেতে হবে। দ্বিতীয়ত. মনোনয়ন নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে যে বাণিজ্যের অভিযোগ ও আশঙ্কা থাকে, এর মাধ্যমে তার রাশ টেনে ধরা যাবে।