'সুন্দর' হয়নি সুন্দরগঞ্জ

পৌরসভা ভবনের ঠিক দক্ষিণ পাশের দেয়ালঘেঁষা খেতে হালের গরু ও লাঙল দিয়ে চাষ করছিলেন যুবক আল আমীন। পাশেই কৃষক হাসান আলী তা তদারক করছিলেন। তাঁরা প্রথম আলোকে বললেন, ধান কাটা শেষে এখন এই খেতে কচুর চাষ করবেন। জমিটি বর্গা নিয়েছেন।
পৌরসভার কার্যালয়ঘেঁষা পাশের আরেকটি খেতে এখনো ধান কাটা হয়নি। আশপাশের কয়েকটি খেত খালি পড়ে আছে।
এটি গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার খণ্ড চিত্র। এক যুগ আগে এটি পৌরসভা হয়ে বাসিন্দাদের কর বাড়লেও নেই কোনো নাগরিক সুবিধা। নেই পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা, নেই ভালো ড্রেনের ব্যবস্থা। ইটের তৈরি মাত্র দুই কিলোমিটার ড্রেন থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। নেই পাইপ দিয়ে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা। নাগরিকেরা নিজেদের উদ্যোগে নলকূপের সাহায্যে পানির চাহিদা পূরণ করেন। পৌরসভার মোট ৩০ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে ১২ কিলোমিটারই কাঁচা। পাকা রাস্তাগুলো সরু, সংস্কারের অভাবে ভাঙাচোরা। কিছু এলাকার রাস্তা এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে। নেই পর্যাপ্ত সড়কবাতি। অর্থাৎ পৌরসভা হলেও ‘সুন্দর’ হয়নি সুন্দরগঞ্জ।
গত মঙ্গলবার গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই পৌরসভায় গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।
নাগরিক-সুবিধা না থাকায় এখানকার মানুষ পৌরসভা হওয়া নিয়ে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। পৌরসভা ভবনের কাছেই কলেজ রোডের বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নিজামউদ্দিন প্রথম আলোকে বললেন, পৌরসভার বড় কাজ হলো নাগরিকদের জন্য ড্রেন, পানি, রাস্তাঘাটসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুবিধা নিশ্চিত করা। কিন্তু এখানে এর কোনোটাই নেই। উপরন্তু নাগরিকদের ওপর করের বোঝা চাপানো হয়েছে। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বললেন, পৌরসভা করে রাজনৈতিক কিছু মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন হলেও সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয়েছে।
পৌর এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বললেন, পৌরসভাটি রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয়েছে।
পৌরসভা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০৩ সালে দহবন্ধ ইউনিয়নের একাংশ নিয়ে এই পৌরসভা গঠিত হয়। জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় সাবেক সাংসদ আবদুল আজিজ পৌরসভাটি গঠনের পেছনে ভূমিকা রাখেন। তিনি একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত হয়ে এখন পলাতক।
পৌরসভাটির আয়তন মাত্র ৬ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ১৭ হাজার ১৬৮ জন। আর ভোটার ১২ হাজার ৫০৪ জন। পৌরসভায় মোট পরিবারের সংখ্যা ৪ হাজার ২৫২টি।
পৌরসভার একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেছেন, পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২, ৪, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড মূলত গ্রাম। এসব গ্রাম এলাকায় সড়কবাতি নেই। রাস্তাঘাটও ভালো নয়।
৪ নম্বর ওয়ার্ডের হুড়া ভায়াখা গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী এনামুল হক বলেন, তাঁদের এলাকায় শহুরে কোনো নাগরিক-সুবিধা নেই। যে রাস্তাটি আছে, সেটিও হয়েছে পৌরসভা হওয়ার আগে। পৌরসভা হওয়ার পর তাঁরা কোনো বাড়তি সুবিধা পাননি। বরং কর বেড়েছে।
পুরো পৌরসভার চিত্রই এমন। জানতে চাইলে বর্তমান মেয়র আবদুল্লাহ আল মামুন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সাত মাস আগে (আগের মেয়র বরখাস্ত হওয়ায় উপনির্বাচনে বিজয়ী) মেয়র হয়েছেন। এরপর তিনি উন্নয়নের জন্য কোনো বাজেট পাননি। ফলে কোনো উন্নয়ন করতে পারেননি।
ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় সাংসদ মনজুরুল ইসলাম তাঁকে কোনো সহযোগিতা করছেন না। উন্নয়ন করতে না পারার এটিও একটি কারণ।
৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় এই সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র পদে নয়জন প্রার্থী থাকলেও মূলত আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী বর্তমান মেয়র আবদুল্লাহ আল মামুন ও বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী পৌর বিএনপির উপদেষ্টা আজাদুল করিম প্রামাণিকের মধ্যে লড়াই হবে বলে পৌরবাসী মনে করছেন। তবে এখানে স্থানীয় সাংসদ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনজুরুল ইসলাম দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করছেন বলে অভিযোগ আছে। যদিও সাংসদ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এই এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর প্রচুর নীরব ভোট আছে। ফলে ‘অসুন্দর’ সুন্দরগঞ্জকে সুন্দর করার দায়িত্ব পৌরবাসী কাকে দেবেন, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত।