শর্ত পূরণ হয়নি, 'বি' শ্রেণিতেই মানবাধিকার কমিশন

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

২০১১ সাল থেকেই জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জাতিসংঘের আওতাধীন এ-সংক্রান্ত সংস্থার ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত। অথচ নেপাল ও আফগানিস্তানের মানবাধিকার কমিশন ইতিমধ্যে ‘এ’ শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। শর্ত পূরণ না করায় ‘এ’ শ্রেণিতে উন্নীত হতে পারছে না মানবাধিকার কমিশন।
এ জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতাকে দায়ী করেছেন। আর মানবাধিকারকর্মীরা বলেছেন, মানোন্নয়নের জন্য কমিশন নিজে যেমন সচেষ্ট হয়নি, তেমনি সরকারের তরফ থেকেও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দেশে সার্বিক মানবাধিকার সংরক্ষণ ও প্রচারে কমিশনের ভূমিকা যে কার্যকর নয়, ‘এ’ শ্রেণিতে উন্নীত না হওয়া তার প্রমাণ।|
বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার কমিশনের গঠন ও কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে এগুলোকে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ শ্রেণিভুক্ত করে জাতিসংঘের আওতাধীন সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটিং কমিটি ফর ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ইনস্টিটিউশনসের (আইসিসি) সাব কমিটি অন অ্যাক্রেডিটেশন (এসসিএ)। যেসব দেশের মানবাধিকার কমিশন স্বাধীন, সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া কাজ করতে পারে এবং আর্থিকভাবে প্রভাবমুক্ত, সেসব দেশের কমিশনকে ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়। ‘বি’ শ্রেণি হলো মাঝামাঝি, অর্থাৎ শর্ত পূরণ করলে ‘এ’ শ্রেণি ভুক্তি। আর ‘সি’ শ্রেণিভুক্ত মানবাধিকার কমিশনের মান খুব অসন্তোষজনক।
আয়ারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ফ্রন্টলাইন ডিফেন্ডার্সের এশিয়া সমন্বয়ক সাঈদ আহমেদ গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি দেশের মানবাধিকার কমিশনের ‘এ’ মর্যাদা পাওয়ার অর্থ হচ্ছে দেশটিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মানবাধিকার কমিশন থাকার স্বীকৃতি। ‘এ’ শ্রেণির মানবাধিকার কমিশনগুলো জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অধিক ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন: আইসিসির ভোট প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বিবৃতি দিতে পারে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সূত্র বলেছে, ২০১১ সালে ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত হওয়ার কারণ হিসেবে কমিশনের কিছু সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে আইসিসি। এর প্রথমটি হলো, কমিশনের সচিবসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা সরকারের নিযুক্ত। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদগুলোতে সরকার নিযুক্ত ব্যক্তি থাকা একটি দুর্বলতা। দ্বিতীয়ত, কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা ও নিজস্ব সচিবালয় নেই। আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কমিশনকে কাজ করতে হয়। তৃতীয়ত, কমিশনারদের নিয়োগ নিরঙ্কুশভাবে সরকারের হাতে। এখানে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব নেই।
২০১১ সালের পর চলতি বছরের মার্চে জেনেভায় আইসিসির সাব-কমিটির সভায় আবারও মানবাধিকার কমিশনকে ‘বি’ শ্রেণিতেই রাখা হয়। কমিশন সূত্র বলেছে, সাব-কমিটির সভায় আগের শর্তগুলোর উন্নতি না হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত না করতে পারার যে বাধ্যবাধকতা আছে, তা দূর করতে পরামর্শ দেওয়া হয়।
‘এ’ শ্রেণিতে উন্নীত না হওয়ার জন্য কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান কিছু প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এত কাজ করার পরও ‘এ’ মর্যাদা পাইনি, এটা কষ্টের। কমিশনকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এর নিয়োগ, আর্থিক ক্ষমতা-সংক্রান্ত বিষয়ে আইনের সংশোধন জরুরি। এসব সংশোধন চেয়ে আমরা প্রতিনিয়ত বলছি। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের আমলাতন্ত্র জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চায় না।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের ক্ষেত্রে আইনি প্রতিবন্ধকতার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন যদি আমরা এসব নিয়ে কাজ করতে চাই, তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করতে হবে। কিন্তু মাসের পর মাস যায়, আমাদের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করে না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আমাদের সিদ্ধান্তহীন করে রাখে।’
কমিশনের আইনের সংশোধন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘কাজের স্বাধীনতা যতটুকু, ততটুকু দেওয়ার জন্য আমরা সচেষ্ট আছি। মূল বিষয়টি তো আর্থিক স্বাধীনতা। বিষয়টি জানি। কতটুকু কী করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছি।’ স্বাধীনভাবে কাজ করা নিয়ে আইসিসির মূল্যায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কমিশন প্রতিষ্ঠার তো বেশি দিন হয়নি। বেশি স্বাধীনতা দিয়ে ফেললে আবার এর অপব্যবহার হয় কি না, তা নিয়েও তো সরকারকে ভাবতে হয়।’
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কর্মকাণ্ডের নিজস্ব ম্যান্ডেট আছে। এর অপব্যবহার হওয়ার কোনো কারণ নেই। আইনমন্ত্রীর এ কথার মধ্যে কমিশনকে স্বাধীন করতে আন্তরিকতার অভাবের চিত্র ফুটে ওঠে। কমিশনের ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত না হওয়ার পেছনে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ে সরকারি নীতিকেই প্রতিবন্ধকতার মূল কারণ বলে মনে করেন তিনি।