বাসায় ঢুকে খ্রিষ্টান তিন ভাইবোনকে গুলি ও কুপিয়ে জখম

রাজধানীর তেজগাঁও থানাধীন আরজতপাড়ায় গত বুধবার গভীর রাতে নিজ বাসায় খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী তিন ভাইবোন দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত হয়েছেন। গুলি ও কোপে আহত এ তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আহত ব্যক্তিরা হলেন লরেন্স রঞ্জন ডি ক্রুজ (৩৭), তাঁর ছোট ভাই আলেক্সজান্ডার রাজেশ ডি ক্রুজ (৩৫) ও বড় বোন বিপাশা ডি ক্রুজ (৪৩)। বিপাশা ঢাকায় সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের ভিসা শাখায়, রঞ্জন মতিঝিলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ও রাজেশ প্রিমিয়ার ব্যাংকে চাকরি করেন।
পুলিশ বলেছে, এটি ‘দস্যুতার চেষ্টার’ ঘটনা। তবে খ্রিষ্টান সমিতির নেতা ও হামলার শিকার পরিবার মনে করছে, খ্রিষ্টধর্মীয় শিক্ষক, যাজক ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হামলা ও হুমকির ধারাবাহিকতায় এ ঘটনা ঘটেছে।
হাসপাতাল সূত্র বলেছে, রাজেশের ডান হাঁটুতে গুলি লেগেছে, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মুখমণ্ডল ও হাত জখম হয়েছে। রঞ্জনের মেরুদণ্ডে গুলিবিদ্ধ, দুই হাত ও পিঠে ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। বিপাশার ডান হাতে কোপ লেগেছে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সাগর আহম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, আহত ব্যক্তিরা সবাই আশঙ্কামুক্ত। তবে রঞ্জন ও রাজেশের সেরে উঠতে সময় লাগবে।
আরজতপাড়ায় একটি পাঁচতলা বাড়ির দোতলায় ভাড়া থাকেন স্ত্রী-সন্তানসহ রাজেশ, তাঁর বড় ভাই-বোন ও মা। পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে দুর্বৃত্তরা সীমানাদেয়াল বেয়ে পাশের ঝোলানো ছাদ থেকে ওই বাড়ির দোতলার খোলা বারান্দায় ওঠে। এরপর জানালার গ্রিল কেটে ভেতরে ঢোকে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই বাসায় গেলে আহত তিনজনের মা রেখা তেরেসা ডি ক্রুজ বলেন, ‘আমি ও বিপাশা এক ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। পাশের ঘরে ছিল রাজেশ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তান। অন্য ঘরে রঞ্জন। টের পেয়ে বিপাশার ঘুম ভেঙে গেলে সে দেখে, তিনজন লোক খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বিপাশা চিৎকার দিলে তাঁর মুখ চেপে ধরে তারা। তখন ধস্তাধস্তির মধ্যে বিপাশার হাতে কোপ লাগে। ওরা বলছিল, “আমরা ডাকাত, চিৎকার করবি না।’”
রেখা তেরেসা বলেন, ‘বিপাশার চিৎকার শুনে আমার দুই ছেলে বেরিয়ে এলে বসার ঘরে তাঁদের সঙ্গে দুর্বৃত্তদের ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে তারা আমার দুই ছেলেকেও কোপায়। তারা পিছু হটে ব্যালকনিতে চলে যাওয়ার সময় দুজনকেই গুলি করে। পরে ব্যালকনি দিয়ে দোতলার কাছে ঝুলন্ত ছাদে নেমে সীমানাদেয়াল টপকে চলে যায়। তাঁরা “ডাকাত, ডাকাত” চিৎকার করলেও বাড়ির বা আশপাশের কেউ এগিয়ে আসেনি। হামলাকারীরা বাসার এলইডি টিভির প্লাগ খুললেও নেয়নি। রুমাল দিয়ে হামলাকারীদের মুখ বাঁধা ছিল।’ তিনি বলেন, টিভি খুলে নেওয়ার চেষ্টা হলেও তাঁর সন্দেহ, এটি ডাকাতির ঘটনা নয়। তাঁদের সঙ্গে কিংবা তাঁর ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও কারও শত্রুতা নেই। তাই এই হামলার কারণ তাঁরা বুঝে উঠতে পারছেন না। তাঁরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
ওই বাড়ির পঞ্চম তলায় থাকেন রঞ্জনের খালা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চিৎকার শুনে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। এরপর রঞ্জনের মায়ের ফোন পেয়ে তিনি দ্রুত দোতলায় গিয়ে দেখেন, রঞ্জন বসার ঘরে মেঝেতে ও রাজেশ সোফায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। প্রথমে তাঁদের স্থানীয় আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে তাঁদের ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়। তিনি বলেন, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও হুমকির ধারাবাহিকতায় এই ঘটনা ঘটেছে।
ওই বাড়ির মালিক লিও গমেজ থাকেন তৃতীয় তলায়। তাঁর মেয়ে শিউলি গোমেজ বলেন, এই বাড়ির সব বাসিন্দা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের। বাড়িতে নিরাপত্তাকর্মী নেই। প্রধান ফটক সব সময় তালাবদ্ধ থাকে। সব ভাড়াটের কাছে প্রধান ফটকের চাবি দেওয়া আছে। বুধবার গভীর রাতে কান্নাকাটি শুনেছেন, কিন্তু কিছু বুঝতে পারেননি। শোরগোল শুনে বারান্দায় গিয়ে দেখেন, বাড়ির সামনে লোকজন জড়ো হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, রাতে আরজতপাড়ায় পুলিশ টহল দেয় না। এমনকি বাড়িমালিক সমিতির পক্ষ থেকে পাহারার জন্য নিরাপত্তাকর্মীও নিয়োগ করা হয়নি।
দুপুরে দোতলার ব্যালকনির দেয়াল ও মেঝেতে রক্তের দাগ এবং বাসার বাইরে পাশের বাড়ির দেয়ালে রক্তমাখা হাতের বেশ কয়েকটি ছাপ দেখা গেছে। পুলিশ ওই ব্যালকনি থেকে গুলির দুটি খোসা, একটি চাপাতি, একটি রেঞ্চ ও একটি টর্চলাইট উদ্ধার করেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তরের যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সকালে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন। বিপ্লব কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, দুর্বৃত্তরা সংখ্যায় ছিল তিনজন। তাঁদের বয়স ১৫-২০ বছরের মধ্যে। তদন্তে জানা গেছে, অদক্ষ এই দুর্বৃত্তরা প্রতিরোধের মুখে পড়ে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়ে ডাকাতি না করেই পালিয়ে গেছে। তারা স্থানীয়ও হতে পারে। তাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলছে।
বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্মল রোজারিও বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, গত এক বছরে আরজতপাড়ায় তিনজন খ্রিষ্টান বাসিন্দার বাসায় হামলা হয়েছে। এ সময় সারা দেশে খ্রিষ্টধর্মীয় শিক্ষক, গির্জার যাজকসহ খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ২৬ জনের ওপর হামলা ও হুমকি দেওয়া ঘটনা ঘটেছে। এর ধারাবাহিকতায় বুধবার রাতে আরজতপাড়ায় পরিবারটির ওপর হামলা হয়েছে। এ অবস্থায় সংখ্যালঘু এই সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তিনি সরকারের কাছে খ্রিষ্টানদের নিরাপত্তা বিধান ও আরজতপাড়ায় হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।