মন্ত্রীদের বেলায় পিছু হটল নির্বাচন কমিশন

পৌরসভা নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন থেকে পিঠটান দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে তারা আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য মন্ত্রী-সাংসদদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না। এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব তারা রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠার পর কমিশন এই অবস্থান নিয়েছে।
কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, মন্ত্রী-সাংসদদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ কমিশনের তুলনায় স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের অপেক্ষাকৃত কম। কমিশন জেনে-বুঝে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অর্থ দাঁড়ায় যে তারা মন্ত্রী-সাংসদদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে চায় না। এর ফলে মন্ত্রী-সাংসদদের মধ্যে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ার প্রবণতা বাড়বে। নির্বাচনী মাঠে এটা সবার জন্য সমান সুযোগের ক্ষেত্র নষ্ট করবে।
পৌরসভা নির্বাচনের আচরণবিধিতে বলা আছে, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ উপনেতা, চিফ হুইপ, হুইপ, বিরোধীদলীয় নেতা, বিরোধীদলীয় উপনেতাসহ সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সিটি করপোরেশনের মেয়র ও সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না।
কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তিনি ছয় মাসের কারাদণ্ডে বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানার দণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণে কমিশন প্রার্থীর প্রার্থিতাও বাতিল করতে পারে। নির্বাচন পরিচালনা বিধিতে বলা আছে, নির্বাচন কমিশনের কাছে সন্তোষজনক মনে না হলে কমিশন ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে সামগ্রিক নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে। জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আইনে কমিশনকে সুস্পষ্ট ক্ষমতা দেওয়া থাকলেও কমিশন তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করছে না।
এ বিষয়ে গতকাল নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক ও মো. শাহ নেওয়াজের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
তবে কমিশন সচিবালয়ের সচিব সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দুই মন্ত্রী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন কি না, বা করে থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে জানতে চেয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী-সাংসদদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দেওয়ার বিষয়ে সচিব কোনো মন্তব্য করেননি।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে কমিশন গত রোববার সাংসদ এম এ মালেক (ঢাকা-২০), শফিকুল ইসলাম (নাটোর-২) ও শওকত হাচানুর রহমানকে (বরগুনা-২) কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। জবাবে তিন সাংসদ দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ভবিষ্যতে আচরণবিধি মেনে চলার অঙ্গীকার করেন।
এরপর ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ফুলপুর পৌরসভায় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান একটি পথসভায় বক্তব্য দেন। সেখানে সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাওয়া হয়, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
এই পর্যায়ে এসেই মূলত পিঠটান দিয়েছে কমিশন। গতকাল বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের ফুলপুর পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তাকে (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-ইউএনও) পাঠানো চিঠিতে কমিশন বলেছে, ময়মনসিংহের ফুলপুর পৌরসভায় ৭ ডিসেম্বর তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে তা কমিশনকে জানাতে বলা হয় চিঠিতে।
জানতে চাইলে ফুলপুরের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ইউএনও সুব্রত পাল প্রথম আলোকে জানান, এ-সংক্রান্ত কোনো চিঠি এখনো পাননি। তবে তিনি বলেন, ৭ ডিসেম্বর শেরপুর থেকে ফেরার পথে তথ্যমন্ত্রী ফুলপুরে একটি পথসভায় রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। এতে তিনি কারও জন্য ভোট চাননি। তবে কিছুক্ষণ পর ধর্মমন্ত্রী ওই সভায় যোগ দিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়েছেন।
এবারের নির্বাচনে ২৩৪টি পৌরসভার মধ্যে ১৭৫টিতে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও)। বাকি পৌরসভার দায়িত্বে আছেন উপসচিব পদমর্যাদার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও ইউএনওদের ভূমিকা নিয়ে যখন সমালোচনা চলছে, তখনই নির্বাচন কমিশন এমন একটি সিদ্ধান্ত নিল।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, একজন ইউএনও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবেন? বাস্তবে তাঁর কি সেই সাহস আছে? তিনি বড়জোর প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। এ ধরনের ঘটনায় বরং ইউএনও কমিশনকে চিঠি দিয়ে মন্ত্রী-সাংসদদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলবেন। এখন হয়ে গেল উল্টো। এতে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা আরও বাড়তে পারে।