হারুনদের গায়ে হরতালের আগুন

চার দিনের হরতাল শুরু হওয়ার আগে গত শনিবার রাতে ময়মনসিংহে হরতাল-সমর্থকেরা মাইক্রোবাসে আগুন ধরিয়ে দিলে চালক হারুনুর রশীদ গুরুতর দগ্ধ হন। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। পাশে স্ত্রী ফরিদা আক্তার ও সন্তানেরা। গতকাল দুপুরে ছবিটি তুলেছেন সাজিদ হোসেন
চার দিনের হরতাল শুরু হওয়ার আগে গত শনিবার রাতে ময়মনসিংহে হরতাল-সমর্থকেরা মাইক্রোবাসে আগুন ধরিয়ে দিলে চালক হারুনুর রশীদ গুরুতর দগ্ধ হন। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। পাশে স্ত্রী ফরিদা আক্তার ও সন্তানেরা। গতকাল দুপুরে ছবিটি তুলেছেন সাজিদ হোসেন

প্রায় পুরো শরীর ব্যান্ডেজে মোড়া। মুখেরও এক পাশ দগ্ধ। শ্বাস নিচ্ছেন হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে।
বাবা হারুনুর রশিদকে (৩২) কখনো এমন অসহায় অবস্থায় দেখেনি ছোট্ট শিশু মীম ও মো. ফরহাদ। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ঢুকে তাই মা ফরিদা আক্তারকে জড়িয়ে ধরে বাবার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল তারা। তারা আগুন চেনে, কিন্তু হরতালের আগুন কী তো বোঝে না!
গত শনিবার রাতে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের সামনে হরতাল-সমর্থনকারীদের ছোড়া পেট্রলবোমায় ঝলসে যায় হারুনুর রশিদের শরীর। শুধু হারুন নন, গত শনিবার হরতালের আগের রাতে ও গতকাল রোববার ভোরে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে হরতাল-সমর্থনকারীদের দেওয়া আগুনে ঝলসে গেছেন আরও তিনজন। ফরিদপুরে বোমা বিস্ফোরণে আহত হয়েছে দুই প্রতিবন্ধী শিশু। এরা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। সর্বশেষ গত রাতে রংপুরে এক মোটরসাইকেল আরোহীর গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের তথ্য এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, গত ২৬ অক্টোবর থেকে গতকাল ১০ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ককটেল ও পেট্রলবোমা হামলায় আহত হয়েছে অন্তত ৪৪ জন। এর মধ্যে শিশু-কিশোর অন্তত নয়জন। সাভারের মোস্তাফিজুর রহমান ও গাজীপুরের কিশোর মনির হোসেন মারা গেছে হরতালের আগুনে। তাদের ভেতরে রেখে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে এ পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন অন্তত ২৫ জন। এখনো ভর্তি আছে ১০ জন।

ইউনিটের পরিচালক সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, যানবাহনে অগ্নিসংযোগের কারণে পুড়ে যাওয়া বেশ বিপজ্জনক। যানবাহনে আগুন দেওয়ার পর ভেতরে থাকা কেউ সঙ্গে সঙ্গে বের হতে পারেন না। তখন শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরের ভেতরে অনেক ধোঁয়া ঢোকে। এতে শ্বাসনালিও দগ্ধ হয়। তখন শরীর কম পুড়লেও জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।

গতকাল দুপুরে বার্ন ইউনিটে গেলে হারুনের স্বজনেরা জানান, হারুন একটি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক। দুই শিশুসন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন ময়মনসিংহের মাসকান্দায়। শনিবার গফরগাঁও থেকে এক কর্মকর্তাকে শাঙ্কিপাড়ায় নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরছিলেন তিনি।

স্বজনেরা জানান, বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে চলছে এই দরিদ্র মানুষটির চিকিৎসা। খবর পেয়ে সন্তানদের নিয়ে ছুটে আসা স্ত্রী ফরিদা যে কয়েক দিন ঢাকায় থাকবেন, তারও কোনো ব্যবস্থা নেই।

হারুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটি ঢিল আইসা কপালে লাগে। হাত দিয়া চাইপা ধরতেই গাড়ির পেছনের সিটে কী যেন একটা পইড়া বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হইয়া আগুন ধইরা যায়।’

চিকিৎসকেরা জানান, হারুনের শরীরের চার ভাগের এক ভাগ পুড়ে গেছে। তবে এখনো আশঙ্কামুক্ত নন তিনি।

পেট্রলের আগুনে দগ্ধ আবদুল হাই: গতকাল রাত ১০টার দিকে রংপুর নগরের পীরপুর এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আবদুল হাই (৪৫) মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনি রেলওয়ে স্টেশন রোডের আলমনগর পীরপুর এলাকায় বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালে মুখোশ পরা দুই ব্যক্তি তাঁর মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। তারা মোটরসাইকেলে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলে তাঁর গায়ে আগুন ধরে যায়। তাঁর চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে তাঁকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক বিকাশ সাহা বলেন, তাঁর শরীরের কোমর থেকে পা পর্যন্ত আগুনে ঝলসে গেছে। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।

কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মিজানুর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, হরতাল সমর্থকেরা এ ঘটনা ঘটাতে পারে। জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

শিশু রনি: গত শনিবার কাজ শেষে রাজধানীর মিরপুরের শাহ আলী থানার দিয়াবাড়ী এলাকায় সড়কের পাশে রাখা বাসেই ঘুমিয়ে ছিল চালকের সহকারী মোহাম্মদ রনি (১৩)। গতকাল ভোরে বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয় হরতালকারীরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রনির পাশে বিমর্ষ বাবা মোহাম্মদ আলমাসের একটাই প্রশ্ন, ‘আমার পোলা তো ঘুমাইয়া ছিল। গাড়ি তো চালায় নাই। এ আগুন ক্যান?’

গতকাল দুপুরে বার্ন ইউনিটের নিচতলায় গিয়ে শিশু রনিকে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখা গেছে। পাশে বাবা আলমাস, মা সুজিনা বেগমসহ স্বজনেরা। হাত, পিঠ, বুক ও মুখ পুড়ে গেছে রনির।

রনি সাংবাদিকদের জানায়, সে জনসেবা পরিবহনের বাসচালকের সহকারীর কাজ করে। গত শনিবার আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বাসে করে মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় নামানো হয়। সেখান থেকে চালক বাসসহ তাকে নিয়ে যান দিয়াবাড়ী এলাকায়। সড়কের পাশে বাস রেখে চলে যান চালক। রাত নয়টার দিকে দরজা-জানালা বন্ধ করে ভেতরে ঘুমিয়ে পড়ে রনি।

রনি জানায়, ‘হঠাৎ আগুনের তাপ পাইয়া ঘুম ভাইঙ্গা যায়। চোখ মেইল্যা দেখি, চারদিক আগুন আর ধোঁয়ায় ছাইয়া গেছে। চিক্কুর দিছি অনেক...কেউ শুনে নাই...অনেক কষ্ট কইরা ডান পা দিয়া একটা জানালা ভাঙ্গি। পা কাইট্টা যায়। ওই জানালা দিয়া লাফ মাইরা বাস থেকে বাইর হওয়ার পর অজ্ঞান হইয়া যাই।’ রনি জানায়, হরতালের কারণে বাসায় চলে যেতে চাইলেও তার চালক মোহাম্মদ শাহীন ‘কোনো সমস্যা অইব না’ বলে তাকে বাসে রেখে যান।

বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল সাংবাদিকদের বলেন, রনির শরীরের ১৩ শতাংশ পুড়ে গেছে। তবে ধোঁয়া ঢুকে যাওয়ায় তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সে এখনো আশঙ্কামুক্ত নয়।

রনির বাবা আলমাস বলেন, ‘গার্মেন্টসের কাপড়ের বোঝা টানি। সংসার চলে না। তাই পোলারে কাজে দিছিলাম। প্রতিদিন সে ৫০-৬০ টাকা পাইত। ওইহান থেইকা সংসারের খরচ দিত ২০ টাকা।’

আবদুর রাজ্জাক: হরতালের সহিংসতার শিকার একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির নিউমার্কেট শাখার পিয়ন আবদুর রাজ্জাক। যন্ত্রণায় বার্ন ইউনিটের বেডে কাতরাতে দেখা গেছে তাঁকেও। পাশে মা মনোয়ারা বেগম ও বাবা কামাল উদ্দিন। গত শনিবার রাতে শাহবাগ থেকে বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে গুলিস্তান যাচ্ছিলেন তিনি। সেখান থেকে আরেকটি গাড়িতে কেরানীগঞ্জের বাসায় ফেরার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু যেতে হয়েছে হাসপাতালে। বাসটি শাহবাগে শিশুপার্কের সামনে পৌঁছালে উড়ে এসে তাঁর হাতে এসে পড়ে একটি পেট্রলবোমা। ঝলসে যায় পুরো শরীর।

বাবা কামাল মিয়া বলেন, দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে রাজ্জাক সবার ছোট। বিয়ে করে বড় ছেলে আলাদা হয়ে গেছেন। বাবা-ছেলের আয়েই চলে সংসার। কিন্তু ছেলের এই অবস্থায় চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি।

হরতালকারীদের আগুনে দগ্ধ হয়ে পিকআপ ভ্যানের চালক সাবু আক্তার গতকাল সকালে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে গেছেন। গত শনিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে ধানমন্ডি ১৩ নম্বর এলাকায় পিকআপ ভ্যান দাঁড় করান তিনি। এ সময় কয়েক যুবক এসে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন।

এই চার আহত ব্যক্তির খবর জানতে গিয়ে কথা হয় আগের হরতালে দগ্ধ হওয়া একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হাসু আহমেদ, লেগুনাচালক আল আমীন, পোশাককর্মী নাসিমা বেগম, শিশু সুমি ও তার দাদি রহিমা বেগম, সিএনজিচালক আসাদুল গাজী ও তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে। তাদের শরীরে জ্বালাপোড়া, মাথায় সংসার আর চিকিৎসার খরচ জোগানোর চিন্তা।

আহতদের দেখতে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান: গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বার্ন ইউনিটে যান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপায় হিসেবে হরতাল হতেই পারে, তবে সহিংসতা নয়। মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করতে চায়। তা প্রতিষ্ঠা করা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, ছায়া সরকার হিসেবে বিরোধী দলকেও এগিয়ে আসতে হবে।

রেহাই পেল না দুই প্রতিবন্ধী শিশুও: আমাদের ফরিদপুর অফিস জানায়, গতকাল দুপুরে ফরিদপুরের রাজবাড়ী রাস্তার মোড় এলাকায় বোমা বিস্ফোরণে আহত হয় হুমায়ুন কবির (১৩) ও রায়হান ব্যাপারী (১০) নামের দুই বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী। তারা ফরিদপুরের রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে সরকারি বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র।

দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তারা বিদ্যালয়ের পেছনের দিকে যায়। হঠাৎ সেখানে বিকট শব্দে বোমা বিস্ফোরিত হয়। বোমায় হুমায়ুনের ডান পায়ের হাঁটুর মাংস উড়ে গেছে। তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আর রায়হানের ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে আঘাত লাগে। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুকুমার গোলদার বলেন, কীভাবে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল, তা জানা যায়নি। তদন্ত চলছে।