হরতালে চট্টগ্রামে নিহত ২

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের ডাকা টানা চার দিনের হরতালের প্রথম দিন গতকাল রোববার চট্টগ্রামে দুজন নিহত হয়েছে। হাটহাজারীতে পিকেটারদের ধাওয়ায় অটোরিকশা উল্টে নিহত হন যাত্রী নির্মল জলদাস (৪৫)। রাতে লোহাগাড়া উপজেলায় ছাত্রলীগের নেতা মাহবুবুর রহমানকে (২৪) গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হত্যাকারীরা শিবিরের ক্যাডার বলে পুলিশ ধারণা করছে।

চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে হরতাল-সমর্থকদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। পিকেটাররা ৩০টির বেশি যানবাহন ভাঙচুর করেছেন, আগুন দিয়েছেন এবং রেললাইন উপড়ে ফেলেছেন। তবে রাজধানীতে কোথাও সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়নি। কয়েকটি জায়গায় হরতাল-সমর্থকেরা চোরাগোপ্তা ককটেল বিস্ফোরণ এবং যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ১৫০ জন আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় অন্তত ১৭৯ জন নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে।

১৮-দলীয় জোট নির্দলীয় সরকারের দাবি ও শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গতকাল রোববার সকাল ছয়টা থেকে টানা ৮৪ ঘণ্টার হরতালের ডাক দেয়। আগামী বুধবার সন্ধ্যা ছয়টায় হরতাল শেষ হবে। এর আগে গত ২৭ থেকে ২৯ অক্টোবর এবং ৪ থেকে ৬ নভেম্বর বিরোধী দল টানা ৬০ ঘণ্টা করে দুই দফায় ১২০ ঘণ্টা হরতাল ডাকে।

ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক, আঞ্চলিক অফিস ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

রাজধানীতে কয়েকটি জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। নয়াপল্টন, মৌচাক, বাঙলা কলেজের সামনে, সোনারগাঁ হোটেল মোড়সহ কয়েকটি এলাকায় ককটেল ফাটানো হয়। নাশকতা চেষ্টার অভিযোগে পুলিশ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে ছয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।

মহাখালী, গাবতলীসহ রাজধানীর আন্তজেলা বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। বড় বিপণিবিতানগুলো বন্ধ ছিল। কাঁচাবাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও দাম ছিল বাড়তি। বিক্রেতারা বলেন, চার দিনের হরতালে দাম আরও বাড়বে।

বরাবরের মতোই খুব ভোর থেকেই নয়াপল্টনের বিএনপি কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই কার্যালয়ে শনিবার ভোর থেকেই একরকম বন্দী অবস্থায় আছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। নেতা-কর্মীদের কাউকেই কার্যালয়ে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এর মধ্যেই বিকেলে একাই সংবাদ সম্মেলন করে রিজভী দাবি করেন, প্রথম দিনে সারা দেশে সাত শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়, এক হাজার ৮০০ নেতা-কর্মী আহত হন, আট হাজারের বেশি নেতা-কর্মীর নামে মামলা দেওয়া হয়েছে।

মিরপুর শাহ আলী মাজার এলাকায় রাস্তার পাশে একটি বাসে ও দৈনিক বাংলা মোড়ে একটি অটোরিকশায় আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। দৈনিক বাংলার মোড় থেকে এ সময় দুজনকে আটক করা হয়।

এ ছাড়া পুরান ঢাকার প্যারীদাস রোডে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল, সূত্রাপুর থানা যুবদলের নেতা-কর্মীরা লক্ষ্মীবাজারে এবং মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজসহ বিভিন্ন এলাকায় মিছিল করেন।

চট্টগ্রামে অটোরিকশার যাত্রী নিহত: হাটহাজারীতে গতকাল সকালে পিকেটারদের ধাওয়ায় সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা উল্টে ইউএসটিসির বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালের কর্মচারী নির্মল জলদাস (৪৫) নিহত হয়েছেন। তিনি সকালে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছিলেন। সকাল পৌনে সাতটার দিকে হাটহাজারীর মদুনা ঘাট এলাকায় পিকেটাররা অটোরিকশাটিকে ধাওয়া করলে এটি উল্টে নির্মল আহত হন। তাৎক্ষণিক তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃতৃ ঘোষণা করেন। নির্মলের বাড়ি হাটহাজারীর কাটাখালী জলদাসপাড়ায়।

লোহাগাড়ার বারলিয়া কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহবুব গত রাত ১২টার দিকে আমিরাবাদ এলাকা থেকে রিকশায় করে তাঁর সুখছড়ি এলাকার বাড়ি ফিরছিলেন। পথে কয়েকজন দুর্বৃত্ত রিকশার গতিরোধ করে। এ সময় তিনি রিকশা থেকে নেমে দৌড় দিলে দুর্বৃত্তরা তাঁকে ধাওয়া করে ধরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে।

থানার ওসি মো. শাহজাহান বলেন, এই এলাকাটি জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত। ওই দলের ক্যাডাররা তাঁকে হত্যা করতে পারে।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম নগরের এ কে খান মোড়, অলংকার, সাগরিকা ও কর্নেলহাট এলাকায় হরতালকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে পুলিশের ১২ জন সদস্যসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন।

 রাত আটটার দিকে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশে মহানগর দায়রা জজ এস এম মজিবুর রহমানের বাসভবনে ককটেল নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর বিচারকের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। মহানগর দায়রা জজ আদালতে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার বিচার চলছে। মজিবুর রহমানের আদালতে এই মামলার বিচারকাজ চলছে। এ ছাড়া তাঁর আদালতে চট্টগ্রামের আরও বেশ কয়েকটি আলোচিত মামলার বিচার চলছে। পাঁচলাইশ থানার ওসি এস এম আতাউর রহমান বলেন, বাসার সামনে গাড়ির পাশে ককটেল বিস্ফোরিত হয়। জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।

এদিকে খুলশী এলাকায় সন্ধ্যায় ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের কার্যালয়ের সীমানাপ্রাচীরে ককটেল ফাটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। খুলশী থানার ওসি মাইনুল ইসলাম জানান, হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

মিরসরাইয়ে শনিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা উপজেলার হাদি ফকিরহাট, মিরসরাই সদর পশুসম্পদ অফিসের সামনে, মাস্তাননগর এলাকায় চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে অন্তত ১০টি গাড়ি ভাঙচুর করেন। একটি যাত্রীবাহী বাস ও একটি ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। রাঙ্গুনিয়ায় মিনা গাজীর টিলা গ্রামে গতকাল দুপুরে বোমা তৈরির সময় সাহাব উদ্দিন (৪০) নামে বিএনপির এক কর্মী আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ছয়টি তাজা বোমা এবং ১২টি বোমার খোসা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে।

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার ভোলাইল ও বন্দর উপজেলায় টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন পিকেটাররা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাঁদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় বেশ কয়েকটি ককটলের বিস্ফোরণ ঘটে।

মাদারীপুরে শনিবার সন্ধ্যায় নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ভাই হাফিজুর রহমান খানের গাড়ি ভাঙচুর করেন হরতাল-সমর্থকেরা। এর পরই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা চরমুগরিয়া এলাকায় স্থানীয় বিএনপির একটি কার্যালয় ভাঙচুর করেন। বরগুনার পাথরঘাটায় জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক এ এফ এম মারুফ চৌধুরীকে বহনকারী ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন হরতাল-সমর্থকেরা।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে নিমতলা বাসস্ট্যান্ডে পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান ভাঙচুর করেছে হরতাল-সমর্থকেরা। এর আধা ঘণ্টা পর একই উপজেলার বেজপাড়া এলাকায় পিকেটাররা একটি ট্রাকে ইটপাটকেল ছুড়ে মারলে সেটি রাস্তার পাশে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। পরে পেছনে থাকা আরও দুটি গাড়ি এসে সেটির পেছনে ধাক্কা দেয়। এতে তিনজন আহত হন।

সাতক্ষীরা শহরের কদমতলা, বাঁকাল, রামচন্দ্রপুর, শহরের ইটাগাছাসহ জেলার সাতটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হরতালের সমর্থনে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও অবরোধ করা হয়। সকাল নয়টার দিকে শহরের রসুলপুর হাইস্কুলের সামনে জামায়াত-শিবিরের ২০-২৫ জন কর্মী তিনটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে দুপুরে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা মিছিল বের করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় পুলিশ গুলি চালালে চার নেতা-কর্মী গুলিবিদ্ধসহ ১০ জন আহত হন।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুর করেন পিকেটাররা। এতে পুলিশ দুজন সদস্যসহ অন্তত আটজন আহত হন। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ বাজারে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশের তিন সদস্যসহ সাতজন আহত হন।

ফেনী শহরের ট্রাংক রোডে প্রেসক্লাবের সামনে দুপুরে পাঁচটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান হরতাল-সমর্থকেরা। পরে যুবদলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় উভয় পক্ষ অন্তত ২৫টি ককটেল ফাটায়। যুবদলের দুই নেতা-কর্মীকে কুপিয়ে আহত করেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা। সংঘর্ষে অন্তত আটজন আহত হন। বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর এবং একটি ট্রাক ও একটি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয়।

চাঁদপুরের বাগড়া বাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে পিকেটারদের ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কয়েক জায়গায় সড়ক অবরোধ করেন হরতাল-সমর্থকেরা।

কিশোরগঞ্জের পুলের ঘাটে সকালে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পাল্টাপাল্টি মিছিল বের করে। একপর্যায়ে দুই পক্ষে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে। চার ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে পুলিশ, সাংবাদিকসহ অন্তত ৫০ জন আহত হন। ভৈরব বাসস্ট্যান্ডে হরতাল-সমর্থকেরা দুটি ট্রাক ও তিনটি মোটরসাইকেলে আগুন দেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাঁদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় বিএনপির ছয় কর্মী আহত হন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হককে গ্রেপ্তারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সকালে পুলিশের সঙ্গে হরতাল-সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। দুপুরে র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে হরতাল-সমর্থকদের দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষ হয়। দুই দফা সংঘর্ষে পুলিশের পাঁচ সদস্যসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন।

জামালপুরের সরিষাবাড়ীর বাঘমারা ব্রিজপাড় এলাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এতে পুলিশের এক সদস্যসহ উভয় পক্ষের ১২ জন গুলিবিদ্ধ হন। হরতাল-সমর্থকেরা পাঁচটি যানবাহন ভাঙচুর করেন। কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে দুটি ট্রাকে এবং ভেড়ামারায় একটি বাসে আগুন দেন হরতাল-সমর্থকেরা।

নাটোরের সিংড়া উপজেলার পাঙ্গাশিয়া বাজারে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কর্মীদের সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হন। সদর উপজেলার হয়বতপুরে গাছের গুঁড়ি ফেলে নাটোর-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। ভাঙচুর করা হয় আটটি ট্রাক ও একটি বাস।

সিরাজগঞ্জ শহরের কাঠেরপুল ও সমাজকল্যাণ মোড়ে জামায়াত-শিবির বিক্ষোভ মিছিল বের করে। পিকেটাররা একটি ধানবোঝাই মিনি ট্রাকে আগুন দেন এবং একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করেন। এ ছাড়া মহিলা লীগ কার্যালয়ের সামনে একটি এবং বেলকুচি মুকুন্দগাতী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। পুলিশ পাঁচজনকে আটক করে।

শনিবার দিবাগত ভোররাত সাড়ে তিনটার দিকে হরতাল-সমর্থকেরা রাজশাহী-ঢাকা রেললাইনের নাটোরের লালপুর উপজেলার শ্রীরামগাড়ীতে দেড় ফুট রেললাইন উপড়ে ফেলেন। এরপর সাড়ে ছয় ঘণ্টা ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল।