স্মৃতিসৌধে শহীদদের স্বজনেরা

স্মৃতিসৌধের ওপর দিয়ে জ্বলজ্বলে সূর্যটা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে শহীদ আ ন ম গোলাম মোস্তফার মেয়ে ঊর্মি মোস্তফা খুব নিচু স্বরে বললেন, ‘একটা বিষয় শেয়ার করতে পারি?’
কেন পারবেন না?
ঊর্মি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। বললেন, ‘এটা এমন এক বিষয়, যা অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। আর কেউ বুঝতে পারে না। জানেন, কাদের মোল্লার ফাঁসির খবর শুনে আমার বুক থেকে একটা নিশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল। এ রকম নিশ্বাসের সঙ্গে আমি কোনো দিন পরিচিত ছিলাম না! মনে হলো, সারাটা জীবন বুক ভারী হয়ে ছিল। এ নিশ্বাসের মাধ্যমে আমি যেন নতুন এক জীবনে প্রবেশ করলাম।’
যে শহীদ স্বজনেরা ১৩ ডিসেম্বর বিকেলের কিছু আগে এক হয়েছিলেন রায়েরবাজার বধ্যভূমির স্মৃতিসৌধটার কাছে, তাঁরা সবাই স্বীকার করলেন, এমনটা তাঁদেরও সেদিন মনে হয়েছিল।
শহীদ আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল হাসান বললেন, ‘বিহারিরা আমার বাবাকে এই কাদের মোল্লার হাতেই তুলে দিয়েছিল। আমার বাবাকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। কাদের মোল্লার পর মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। এতে আমি সান্ত্বনা পেয়েছি।’

রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে গতকাল গিয়েছিলেন কয়েকজন শহীদের স্বজন—বাঁ থেকে নিজামুদ্দীন আহমেদের ছেলে শাফকাত নিজাম, রাশীদুল হাসানের মেয়ে রোকাইয়া হাসিনা, আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ, এস এ মান্নানের ভাই শেখ আহমেদ আব্বাস, আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল আহসান, আ ন ম গোলাম মোস্তফার মেয়ে ঊর্মি মোস্তফা ও সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে জাহীদ রেজা নূর l ছবি: প্রথম আলো
রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে গতকাল গিয়েছিলেন কয়েকজন শহীদের স্বজন—বাঁ থেকে নিজামুদ্দীন আহমেদের ছেলে শাফকাত নিজাম, রাশীদুল হাসানের মেয়ে রোকাইয়া হাসিনা, আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ, এস এ মান্নানের ভাই শেখ আহমেদ আব্বাস, আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল আহসান, আ ন ম গোলাম মোস্তফার মেয়ে ঊর্মি মোস্তফা ও সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে জাহীদ রেজা নূর l ছবি: প্রথম আলো

শহীদ নিজামুদ্দীন আহমেদের ছেলে শাফকাত নিজাম একটু চাপা স্বভাবের। যখনই দেখা হয়, কথা বলেন খুব মৃদুস্বরে। তিনি বললেন, ‘পূর্বদেশ পত্রিকায় ঊর্মির বাবার সহকর্মী ছিল চৌধুরী মঈনুদ্দীন। মঈনুদ্দীন আর আশরাফুজ্জামানের রায় কার্যকর করার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো দরকার। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের তো বিচার হচ্ছে। আমাদের এখন আরও অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। পরবর্তী ইতিহাসকে ঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’
এঁরা তিনজন ছাড়াও সঙ্গে ছিলেন শহীদ রাশীদুল হাসানের মেয়ে রোকাইয়া হাসিনা, আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ। আরও কয়েকজন থাকতে পারতেন সঙ্গে, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আসতে পারেননি। আমাদের সঙ্গে আর ছিলেন শেখ আহমেদ আব্বাস—অবজারভার পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক এস এ মান্নান ওরফে লাডু ভাইয়ের ছোট ভাই তিনি। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে শহীদ সাংবাদিকদের স্মরণে আয়োজিত আলোচনা সভায় তাঁকে দেখতে পেয়েছিলাম। আবেগতাড়িত কণ্ঠে তিনি বলছিলেন, ‘কেউ কোনো দিন আমাদের খোঁজ নেয়নি।’ আমরা তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম আমাদের সঙ্গে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে আসতে। আশি পার হয়ে যাওয়া মানুষটি গাড়িতে আসতে আসতে বলছিলেন ভাই হারানোর বেদনার কথা। ১৯৯৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর লাড়ু ভাইয়ের মৃত্যুদিনে বাদ মাগরিব মিলাদের পর তখনো অতিথিরা বাড়িতে ছিল। সেদিনই মারা গেলেন তাঁর মা। মা ও ছেলে বেশ কয়েক বছরের ব্যবধানে একই দিনে চলে গেলেন, সে কথা বলতে গিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন বর্ষীয়ান এই ভদ্রলোক। আমরা কেউ তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম না। কাঁদুক আব্বাস চাচা। কেঁদে হালকা হোক তাঁর বুক।
ঝাড়পোছ চলছে বধ্যভূমিতে। কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকেরা খবরের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এদিক-ওদিক। ঠিক এ সময় আকাশে দেখা গেল চিল। শাওন মাহমুদ বললেন, ‘এখনো চিল উড়ে বেড়ায় এখানে!’
আমাদের মনে পড়ে যেতে পারত রুশ ছবি ক্রেইনস আর ফ্লাইং-এর শেষ দৃশ্যটির কথা। যুদ্ধে নিহত প্রেমিকের শোকে মুহ্যমান মেয়েটি আকাশে উড়ে যাওয়া সারিবদ্ধ বলাকা দেখে জীবনের প্রতি আবার আশাবাদী হয়ে ওঠে। হাতে থাকা ফুলগুলো ছড়িয়ে দিতে থাকে যুদ্ধফেরত বীরদের হাতে। কিন্তু আমরা একটু দ্বিধান্বিত হই। বলাকা আর চিল এক নয়। তাহলে কি এখনো গলে যাওয়া কোনো মৃতদেহ রয়ে গেছে এখানে কোথাও? কিংবা ভাবনার মৃতদেহ?
শাওনের দীর্ঘশ্বাসে মিলে যায় আমাদের দীর্ঘশ্বাসগুলো। শাওন বলেন, ‘আপনারা বুঝবেন আমার অনুভূতি। আমার বাবাকে তো ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাঁর লাশ পাইনি। তাই রায়েরবাজারে এলে মনে হয়, বাবা আছেন এখানে। চাইলেই দেখতে পাব তাঁকে। আজ অসম্ভব ভালো লাগছে আমার।’
ও বলেই চলে, ‘এবারের বিজয় দিবসটা আমার কাছে অসাধারণ হয়ে ধরা দিয়েছে। আমি একটা ঘোরের মধ্যে আছি।’
রোকাইয়া হাসিনা রবীন্দ্রসংগীত করেন। জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পঙ্ক্তি ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি’। তিনি বললেন, ‘স্বাধীনতার আগে রাজনৈতিক সভাতেও তো জাহিদুর রহিম, অজিত রায়েরা গাইতে উঠতেন মঞ্চে। রাজনীতি আর সংস্কৃতিকে তো মিলতে হবে। নইলে দুটো ভিন্ন স্রোত হয়ে গেলে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। রায় কার্যকর হওয়ার পর একধরনের স্বস্তি পাচ্ছি।’
এঁরা সবাই একইভাবে নতুন সময়ের কথা বলতে থাকেন। আশার কথা বলতে থাকেন। মায়েদের সংগ্রামের কথা বলতে থাকেন। অস্তিত্বের সংকট কাটিয়ে উঠে ঋজু হয়ে দাঁড়ানোর কথা বলতে থাকেন।
বিদায়বেলায় নিজের অজান্তেই সবাই স্মৃতিসৌধটার দিকে তাকান। একবার উচ্চারিত হওয়া আসাদ চৌধুরীর কবিতার পঙ্ক্তিটি সবার মনে অনুরণিত হতে থাকে, ‘তোমাদের যা বলার ছিল বলছে কি তা বাংলাদেশ?’
আর এই ফাঁকে আমি ভাবি, একাত্তরের শহীদদের সংগঠন প্রজন্ম ’৭১-এর সদস্যদের কাছাকাছি হলে কেন নিজেকে এত আপন মনে হয়? রক্তের বন্ধন আসলে কাকে বলে? সে কি শুধুই বংশপরম্পরার কথা? নাকি যাঁদের রক্তে মুক্ত এ দেশ, তাঁদের স্বজনেরাও আবদ্ধ হয়ে গেছে রক্তের বন্ধনে?
আকাশে তখন নাম না জানা কয়েকটি ছোট ছোট পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে, চিল নয়।
জাহীদ রেজা নূর: শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে।