বিলম্বে হলেও বিচার শুরু হয়েছে

হাসান আজিজুল হক
হাসান আজিজুল হক

একাত্তরে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে খুলনায় আমার গ্রামের বাড়ির এলাকাটা মোটামুটি মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। যৌথ বাহিনী তখন আমাদের এলাকা পার হয়ে আরও এগিয়ে গিয়েছিল। আর যুদ্ধটা হয়েছিল শিরোমণিতে, আরেকটু দূরে। যতদূর জানি, শিরোমণিতেই শেষ মুক্তিযুদ্ধটা ঘটেছিল।
তারপরই এল ১৪ ডিসেম্বর। মফস্বলে থাকি, অত তাড়াতাড়ি খবর পাইনি। আত্মসমর্পণের দিনটিতেই বোধ হয় জেনেছিলাম বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের খবর। অকল্পনীয় ক্ষতি কিছুতেই আটকানো গেল না। এই আফসোস আমার এখনো যায় না।
খুলনা মুক্ত হওয়ার পর গিয়েছি দৌলতপুর কলেজের ভেতরে নিজের বাড়িতে। গিয়ে দেখি, সরু সরু ফুট দেড়েক লম্বা সাদা পাটকাঠি বিছানাসহ যত্রতত্র ছড়ানো। কৌতূহল হওয়ায় একটা পাটকাঠিতে দেশলাই জ্বালিয়ে ছোঁয়ালাম। হুস করে আমার চেয়েও উঁচু একটা আগুন ওপরে উঠে গেল। তখন বোঝা গেল, এই পাটকাঠিগুলো কী মারাত্মক রকমের দহনক্রিয়া সৃষ্টি করে বাড়িঘর মুহূর্তের মধ্যে জ্বালিয়ে দিতে পারে। বাড়ির কোনো কিছু এই হানাদাররা নেওয়ার সময় পায়নি। আমার দোনলা লাইসেন্সপ্রাপ্ত বন্দুকটা বিছানার তলায় যেমনকার তেমনিই রয়েছে। মনে হয়, হানাদার বাহিনীর যে সেপাইগুলো ওখানে ছিল, তাদের পেটে জ্বলছিল খিদের আগুন। আধমণটাক চাল ছিল বাড়িতে। নেই। বাড়ির ভেতরে কয়েকটা কলাগাছ ছিল, কাঁচকলাগুলো আদ্ধেকটা কেটে নিয়ে গেছে, বাকি আদ্ধেকটা গাছেই আছে। বিজয় যখন হয়ে গেছে, তখন এসব দৃশ্য দেখে আমি অপর্যাপ্ত আনন্দ লাভ করলাম। চারদিকে শুধু ফাঁকা গুলির আওয়াজ। মুক্তিযোদ্ধারাই বিজয়ের আনন্দে সে গুলি ছুড়ছিল।
দু-তিনটা দিন এ রকমই কাটল। তখনই শুনলাম বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের খবর। হানাদাররা পরাজিত হয়ে গেছে। দুয়েক দিন পরই আত্মসমর্পণ হবে। তখনই দেশের বাছাই করা শ্রেষ্ঠ মানুষদের বাড়ি থেকে, শোবার ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নৃশংসতম উপায়ে হত্যা করা হলো।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কয়েকটা ছবি আমরা আজও দেখি। সেই একই রকমের অনুভূতি হয়। দেশের বাছাই করা মানুষদের, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হলো। এ কাজ তো পাকিস্তানি বাহিনী একাই করেনি। তাদের সঙ্গে আর কারা এই অপকীর্তি ঘটাল? অপরিসীম ঘৃণা আর ক্রোধে মাথা ছিঁড়ে যেতে চায়, যখন জানি, আগাগোড়া মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নানা স্থানে অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে যারা, তাদেরই একটা অংশ ঢাকায় এই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটাল।
সেই কথা মনে হলে অপরাধীদের একবার ফাঁসি মোটেই যথেষ্ট বলে মনে হয় না। মানুষকে মারলে একবারই মারা যায়। বারবার মারা তো সম্ভব হয় না। সাকা চৌধুরী, মুজাহিদ, নিজামী, সাঈদী—এত দিন মনে হচ্ছিল আমাদের বুকের ওপর বসে গলা চেপে ধরেছে। কিন্তু অপরাধীর শাস্তি হয়। বিলম্বে হলেও হয়। এক শ বছর পরে হলেও যে অপরাধীর শাস্তি হয়েছে, তাও দেখা গেছে। আমাদের এই দেশেই জন্মগ্রহণ করা এই দেশেরই দুশমন, মুক্তিযুদ্ধে যারা নানা অপরাধ করেছিল এবং ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, তাদের শাস্তি চার দশক ধরেও হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত হলো। এর শিক্ষা এটাই, মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ করলে কোনোক্রমেই মাফ পাওয়া যায় না।
একদিনে যেন পুরো জাতি নিঃস্ব হয়ে গেল। সহায়-সম্পদে নিঃস্বতার চেয়ে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার নিঃস্বতা কম ক্ষতির নয়। আমাদের সেই চরম ক্ষতি হলো। সত্যি বলতে কি, নয় মাসজুড়ে গোটা দেশেই অনেক গুণী প্রতিভাবান মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু রাজধানী ঢাকাতেই তাদের ওরা এক জায়গাতেই প্রায় সবাইকে খুঁজে পেয়েছিল। এই ক্ষতিটা সে জন্য পূরণ হওয়ার নয়।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো নয় মাস আমি বাংলাদেশেই ছিলাম। শেষ কদিনে ৭-৮ ডিসেম্বরের দিকে খুলনা শহর থেকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। তখন তাড়া খেয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী খুলনার দিকে দৌড়োচ্ছে। ছত্রভঙ্গ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সেপাইদের একপায়ে বুটজুতো আছে, আরেক পায়ে নেই। রাইফেলও সবার ঘাড়ে নেই। মাঝে মাঝে একটা-দুটো করে বোমারু বিমান আসছে, আর তারা রাস্তার দুই পাশে সরাসরি শুয়ে পড়ছে। এই দৃশ্য দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমি ঘণ্টা তিনেক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তথাকথিত পশ্চাদপসরণ দেখছিলাম। আর ভাবছিলাম, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। সেখানেই সমাপ্তি ঘটবে এই পাকিস্তানি সৈন্যদের পলায়ন-প্রক্রিয়ার। এই কটা দিন যে কীভাবে দেশের মানুষ উৎসব ও আনন্দের ভেতর দিয়ে ভোগ করেছিল, আমার এখনো তা মনে আছে।
১০ ডিসেম্বরের দিকে আমি আবার খুলনার দৌলতপুর কলেজে আমার বাসায় ফিরে আসি। আর শিরোমণিতে শেষ যে যুদ্ধটা হয়েছিল তাতে রাস্তার ওপরে মরা কুকুর, গরু, ছাগল যেমন দেখেছিলাম, ঠিক তেমনি করেই পাকিস্তানি, বিশেষ করে বোধ হয় পাঞ্জাবি সৈন্যদের পচে ফুলে ওঠা মৃতদেহও অনেক দেখেছিলাম। এতটুকু মনের মধ্য করুণার উদ্রেক হয়নি। মনে হচ্ছিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই নয় মাসে যা করেছে, কোনো কিছুতেই তার ন্যায্য প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব হবে না।
আর গণহত্যার কথা? খুলনা শহরে যখন ছিলাম, এপ্রিল-মে-জুন ধরে দেখেছি, ১৮-১৯-২০ বছর বয়সের গ্রামের যুবকদের ঠাসাঠাসি করে ভ্যানে তুলে খুলনা শহরের গল্লামারী খালের ধারে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শত শত পৃষ্ঠা লিখেও গণহত্যার এ বিবরণ লিখে শেষ করতে পারব না। সরাসরি অভিজ্ঞতা যাদের হয়নি, তারা কিছুতেই এটা আন্দাজ করতে পারবেন না। আমি আর সেদিকে গেলাম না।
এসব ঘটনা আমাদের চোখে দেখা। এই রক্তস্রোতের ভেতর দিয়ে আমাদের চলতে হয়েছে। পানির দামে রক্ত বিকিয়েছে বাঙালির। আজ শুনতে পাই, পাকিস্তান নাকি বাংলাদেশে গণহত্যা করেনি! কারা এ কথা বলছে, আমি জানি না। যারা এ কথা বলছে, ১৯৭১ সালে কি তাদের সবাই আদৌ ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন? যদি না হয়েও থাকেন, তাহলে সারা পৃথিবী যা জানে, তাঁরা তা জানেন না—এটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও বারবার তাদের বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে। সেটা তো তারা করেইনি, এই মাথা মোটা দেশটি থেকে এখন শোনা যাচ্ছে, গণহত্যা বলে কোনো কিছু নাকি ঘটেইনি বাংলাদেশে।
আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি, পাকিস্তানের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে সত্যিকারের মানুষ কি আদৌ নেই? সেটাও তো ঠিক নয়। আসমা জাহাঙ্গীরের মতো মানুষ তো সেখানে আছেন। মালালার মতো মেয়েও সেখানে জন্মগ্রহণ করেছেন। কোথাও থেকেও কি তাদের শেখার কিছু নেই? ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে, মানা যায়। সম্প্রদায় মিথ্যা বলে, তাও মানা যায়। কিন্তু রাষ্ট্র যখন মিথ্যা কথা বলে, তখন বোঝা যায়, সে রাষ্ট্র কীটদষ্ট, মানবতাহীনতার চর্চা এখনো এখানে হয়। এর বেশি কী বলার আছে?
বাংলাদেশে যারা যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত হয়েছিল, এত দিন পর হলেও তাদের বিচার ও শাস্তি হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি বিচার হয়ে গেছে, বাকি সবই প্রক্রিয়াধীন। আমরা প্রতিহিংসাবশত এই কাজ করছি না। সমগ্র জাতি সুবিচারের জায়গা থেকেই এই বিচার করছে।