বাঁকখালীর 'মরণ' ঠেকাতে পারছে না কেউ!

কক্সবাজারের শহরের যত ময়লা-আবর্জনা সবই ফেলা হচ্ছে বাঁকখালী নদীতে। উচ্ছেদ হয়নি দখলদার। পাশাপাশি উজাড় হচ্ছে নদীর পাশের প্যারাবন। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। সংকুচিত হয়ে পড়ছে গতিপথ। পরিবেশবাদীদের আশঙ্কা, এই অবস্থা চলতে থাকলে বাঁকখালীর ‘মরণ’ অনিবার্য।
অথচ বাঁকখালীকে বাঁচাতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রশাসনের গরজ কম। খোদ পৌরসভা কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন বর্জ্য ফেলে ভরাট করছে নদী।
৭ জানুয়ারি দুপুরে নদীর কস্তুরাঘাট, পেশকারপাড়া ও ছয় নম্বর জেটিঘাট ঘুরে দেখা গেছে, শহর থেকে পৌরসভার ট্রাকে করে আবর্জনা এনে ফেলা হচ্ছে নদীতে। চারপাশে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এসব আবর্জনা। কস্তুরাঘাটে আবর্জনায় নদী অর্ধেকের বেশি অংশ ভরাট হয়ে গেছে। ওই স্থানে নদীর পানি প্রবাহও অনেকটা বন্ধ।
পেশকারপাড়ার ব্যবসায়ী কামাল আহমদ জানান, সকাল ১১টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত অন্তত ২০ থেকে ২৫টি ট্রাকে ময়লা ফেলা হচ্ছে নদীর কয়েকটি স্থানে। এতে নদীর গতিপথ সংকুচিত হচ্ছে। গতিপথে হওয়ায় বিপাকে পড়ছে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত ট্রলার। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ট্রলারগুলো নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এই নদীতে রাখা হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়কারী আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বাঁকখালী নদী রক্ষায় ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বেলার পক্ষ থেকে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাঁকখালী নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ, বর্জ্য অপসারণ বন্ধ, নদীর সীমানা নির্ধারণসহ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। এরপর প্রশাসন কতিপয় দখলদারের একটি তালিকা তৈরি করে নোটিশ জারি করেছিল। এরপর কয়েক দফা লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান চালায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ হয়নি। উচ্ছেদ হয়নি অবৈধ দখলদারও।
বেলা কক্সবাজারের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, এক সময় বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট ছিল শহরে প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র । আর এখন মৃত্যুপুরী। শহরের একাধিক পাহাড় কাটার মাটি নেমে আসছে নদীতে। আর শহরের ময়লা-আবর্জনা ফেলে নদীর তলদেশ ভরাট করছে খোদ পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। ভরাট নদীতে ময়লা আবর্জনা ও পলিথিন ছড়িয়ে কেওড়া ও বাইন গাছের প্যারাবন মরে যাচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। অন্যদিকে নদীর নাব্যতা হারিয়ে সুপেয় পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। শহরের কয়েক হাজার নলকূপের পানি ইতিমধ্যে লবণাক্ত হয়ে পড়েছে।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, নদীর ভরাট অংশ খননসহ নদী রক্ষার দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধন ও সমাবেশ করে আসছে। কিন্তু কোনো ফল হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে বাঁকখালী মরেই যাবে।
এ ব্যাপারে পৌরসভার মেয়র (ভারপ্রাপ্ত) মাহবুবুর রহমান জানান, প্রায় এক মাস আগে তিনি মেয়রের দায়িত্ব পেয়েছেন। নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের চেষ্টা চালাচ্ছেন। আগের মেয়র (সাময়িক বরখাস্ত) সরওয়ার কামাল শহরের ময়লা আবর্জনা ফেলার জন্য রামুর চাইন্দা এলাকায় জমি কিনেছিলেন। এখন সেখানে ভাগাড় (ডাম্পিং স্টেশন) তৈরির চেষ্টা চলছে। তবে মাহবুবুর রহমান দাবি করেন, এক সময় নদীতে বর্জ্য ফেলা হলেও উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর তা বন্ধ রয়েছে। এখন পৌরসভার ট্রাক দিয়ে নদীতে কারা ময়লা ফেলছে তা খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
এ দিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের উত্তর নুনিয়াছড়া থেকে মাঝেরঘাট পর্যন্ত নদীর প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় ভরাট ও দখল তৎপরতা বেশি। কস্তুরাঘাটস্থ বিআইডব্লিউআইটি টার্মিনাল সংলগ্ন নদীর ভরাট জমিতে গড়ে উঠেছে নানা স্থাপনা। তৈরি হয়েছে চিংড়িঘের, লবণ উৎপাদনের মাঠ, প্লট বিক্রির হাউজিং কোম্পানি, নৌযান মেরামতের ডকইয়ার্ড, ময়দা ও বরফ কল, শুটকিমহালসহ অসংখ্য ঘরবাড়ি।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সর্দার শরিফুল ইসলাম জানান, প্রায় ৮০ কিলোমিটারের এই নদীর বাংলাবাজার থেকে নুনিয়াছটা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার অংশে দখলের ঘটনা বাড়ছে। এসব এলাকায় দখলদারের ্সংখ্যা অন্তত এক হাজার। এই বিপুলসংখ্যক দখলদারকে উচ্ছেদে যৌথ অভিযান দরকার।
জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশে নদীর দখলদারদের তালিকা তৈরি ও ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। এখন নদীর সীমানা নির্ধারণের কাজ চলছে। কিন্তু কতিপয় ব্যক্তির উচ্চ আদালতে মামলা এবং নিষেধাজ্ঞার কারণে উচ্ছেদ অভিযান জোরদার করা যাচ্ছে না।
তা ছাড়া নদীতে জেগে ওঠা চরের জমি বন্দোবস্তি চেয়ে দুটি পক্ষ আবেদন করেছে। এখনো কোনো পক্ষকে ওই জমি বন্দোবস্তি দেওয়া হয়নি।