বাবুলের সঙ্গে পুড়ল তাঁর 'রক্ষাকবচটি'ও

শাহ আলী থানার পুলিশের কাছ থেকে বাঁচার জন্য পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনারের (ডিসি) স্বাক্ষরিত একটি ‘রক্ষাকবচ’ সব সময় পকেটে রাখতেন চা-দোকানি বাবুল মাতবর। কিন্তু থানা-পুলিশ আর তাদের তথ্যদাতার (সোর্স) আগুনে সেই ‘রক্ষাকবচ’ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পুড়ে মরেছেন বাবুলও।
এই ‘রক্ষাকবচ’ আসলে একটি আবেদনপত্র। থানা-পুলিশ থেকে বাঁচার আবেদনপত্র। এর আগেও এমন একটি আবেদনপত্রে উপপুলিশ কমিশনারের সিলযুক্ত স্বাক্ষর নিয়ে এক বছর নিরাপদে ছিলেন বাবুল। কিন্তু এবার আর রেহাই পেলেন না তিনি।
গতকাল শুক্রবার মিরপুরের গুদারাঘাটের এইচ ব্লকের বস্তিতে গেলে বাবুলের বড় ছেলে রাজু আহমেদ জানান, পুলিশের হয়রানি থেকে বাঁচতে ছয় মাস আগে মিরপুর বিভাগের উপপুলিশ কমিশনারের (ডিসি) কাছে আবেদন করেছিলেন বাবুল মাতবর। এই প্রতিবেদককে আবেদনপত্রের একটি ফটোকপি দেন রাজু।
বাবার মৃত্যুর শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি রাজু। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে কান্না থামানোর চেষ্টা করছিলেন। আবেদনপত্রটি হাতে নিয়ে রাজু বলেন, ‘ভাই দেখেন, এটা হলো পুলিশকে দেওয়া চিঠি। আব্বা সব সময় এইটার আসল কপি তাঁর বুকপকেটে রাখত। পুলিশ চান্দা নিতে আইলে দেখাইত। আব্বার লগে লগে ওই আসল কপিটাও পুইড়া গেছে ভাই।’
চাঁদা না দেওয়ায় গত বুধবার চার পুলিশ সদস্যের উপস্থিতিতে বাবুলকে লাথি মেরে জ্বলন্ত চুলার ওপর ফেলে দেন পুলিশের শাহ আলী থানার সোর্স দেলোয়ার। পুড়ে অঙ্গার বাবুল গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান। পুলিশের কাছে করা সেই আবেদনের ফটোকপিটি এখন এই অসহায় পরিবারের স্মৃতি।
গত বছরের ১৬ আগস্ট ডিসির কাছে আবেদনে বাবুল লিখেছিলেন, ‘আমি ইলেকট্রিক্যাল কাজসহ যখন যে কাজ পাই, তখন সে কাজ করে কোনোরকমে পরিবার নিয়ে দিন যাপন করে আসছি। আমি কোনো মাদক খাইও না এবং বিক্রিও করি না। লোক মারফত শুনতে পাই, আশপাশের ঘরের লোকজন নাকি মাদক বিক্রয় করে। উক্ত ঘরে মাদক বিক্রেতাদের খুঁজতে এসে পুলিশ আমাকে নানাভাবে হয়রানি করে। গত বছর আমি আপনার অফিসে একটি দরখাস্ত দেওয়ার পর গত এক বছর যাবৎ থানা-পুলিশ আমাকে হয়রানি করেনি। বর্তমানে আবার থানা-পুলিশ আমাকে হয়রানি করে আসছে। ফলে আমি সব সময় পুলিশের ভয়ে থাকি। থানা-পুলিশ অন্যদের খুঁজতে গিয়ে যাতে আমাকে হয়রানি না করে, এই বিষয়ে শাহ আলী থানাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান এবং আমাকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার সুযোগদানে আপনার মর্জি হয়।’
রাজু বললেন, ‘ডিসি সাব থানায় বলে দিয়েছিলেন। পুলিশও আর ডিস্টাব করত না। কিন্তু মাস খানেক ধরে তারা আবার চান্দা চাওয়া শুরু করে।’
দরখাস্তের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মিরপুরের উপকমিশনার কাইয়ুমুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে খুঁজে দেখতে হবে।’
এদিকে গতকাল শাহ্ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে এম শাহীন মণ্ডলকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ডিএমপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, প্রশাসনিক স্বার্থে তাঁকে কেন্দ্রীয় সংরক্ষণ দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। এর আগে এ ঘটনায় ওই থানার পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
গতকাল বাবুলের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাবুলের ঘরের সামনের রাস্তায় জনা বিশেক প্রতিবেশীর জটলা। সেখানে বাবুলের স্ত্রী লাকী বেগম ও খালা আনোয়ারা বিলাপ করছেন। মায়ের কোলে বসে পাঁচ বছরের শিশু জুনায়েদ ইসলাম (বাবুলের ছোট ছেলে) বলছিল, ‘আব্বা আমারে দুধ খাইতে কইয়া গেছে।’ ছেলের এ কথা শুনে লাকী বেগমের কান্নার তীব্রতা আরও বাড়ছিল।
বাবুলের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শাহ আলী থানাধীন বটতলা, কাঁঠালতলাসহ আশপাশের আরও কয়েকটি সড়কে মুদি দোকানদার, চা-দোকানদার, সিগারেট বিক্রেতাসহ স্থানীয় বাসিন্দা ও কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বিভিন্ন সময় পুলিশের হেনস্তার কথা তুলে ধরেন তাঁরা।
তাঁদের অধিকাংশই জানান, শাহ আলী থানায় পুলিশ সদস্যের চেয়ে সোর্সের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। এই সোর্সদের সঙ্গে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া যে কাউকে হুটহাট ধরে তল্লাশি চালান পুলিশ কর্মকর্তারা। তল্লাশির নামে পুলিশ সদস্যরা পকেটে গাঁজা আর ইয়াবা ঢুকিয়ে আটক করেন। এরপর চলে দরাদরি। যার কাছ থেকে যা পায় তা নিয়ে ছাড়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মুদি দোকানদার বলেন, মাস ছয়েক আগে এক রাতে তাঁর দোকানের সামনে দিয়ে এক ব্যক্তি হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় পুলিশের এক কনস্টেবল তাঁর পথরোধ করে তল্লাশি করেন। কিছুক্ষণ পরই তাঁদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়। এ সময় তিনি কনস্টেবলকে গিয়ে বলেন যে আশপাশে কয়েকটি সিসি ক্যামেরা আছে, তিনি যা করছেন তার সবকিছুই সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ছে। পুলিশ কনস্টেবল তখন কিছু না বলে চলে যান। ওই মুদি দোকানদার বলেন, পুলিশ সদস্য যদি ঠিকই থাকতেন, তাহলে সিসি ক্যামেরার কথা শুনে চলে যেতেন না।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মো. শাহজাহান তালুকদার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর শাহ্ আলী থানার সামনের রাস্তায় একটি গাড়ি নিয়ে দাঁড়ান পুলিশ সদস্যরা। তারপর তল্লাশির নামে ‘ব্যবসা’ শুরু করেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে গতকাল দুপুরে শাহ্ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে থানায় পাওয়া যায়নি। তবে থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) মো. ফিরোজ হোসেন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে সবকিছুর জন্যই লোকজন পুলিশকে দায়ী করা শুরু করে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী মোটর চালক লীগের এক যুগপূর্তি অনুষ্ঠানে চা-দোকানি বাবুল মাতবরের মৃত্যুর বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, শুধু দু-একজন পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত অপকর্মের কারণে পুরো পুলিশ বিভাগকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। ইতিমধ্যে শাহ আলী থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ঘটনায় দোষী পুলিশ সদস্যদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।