স্নাতকেও পাসের ভরসা প্রাইভেট!

নিয়মিত ক্লাস না হওয়া, শিক্ষক-স্বল্পতা ও শ্রেণিকক্ষের সংকটের কারণে পুরো পাঠ্যসূচি শেষ না হতেই চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিতে হচ্ছে দিনাজপুর সরকারি কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষার্থীদের। এ জন্য প্রাইভেট পড়া এখন তাঁদের পরীক্ষায় পাসের ভরসা।
গত রোববার কলেজ চত্বরে গাছের নিচে বসে চতুর্থ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফরম পূরণ করছিলেন তিন শিক্ষার্থী। তিনজনেরই বিষয় ইংরেজি। পরীক্ষা আগামী মাসে। তাঁরা জানালেন, গত জুলাই মাসে তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এরপর ক্লাস হয়েছে দুই থেকে আড়াই মাস। ফলে কোর্স (পাঠ্যসূচি) শেষ হয়নি। তাহলে পরীক্ষায় পাস করবেন কী করে—এমন প্রশ্নে তাঁদের একজন কাজল হোসেন বললেন, ‘ক্লাসে কোর্স শেষ না হওয়ায় কিছুদিন আগে প্রাইভেট পড়েছি। এখন নিজে নিজেই পড়ছি।’
১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত দিনাজপুর সরকারি কলেজে ১৫টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয়। উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক (সম্মান), ডিগ্রি (পাস), স্নাতকোত্তর ও প্রাইভেট মিলিয়ে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ২৮ হাজার। এর মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে শিক্ষার্থী প্রায় ২৪ হাজার।
কলেজের বিভিন্ন বিভাগের অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী ও ৪ জন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ-সংকট এবং বিভিন্ন সময় পরীক্ষার কারণে এমনিতেই সেখানে ক্লাস কম হয়। এর মধ্যে সেশনজট কমাতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষিত ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রামের’ (২০১৮ সাল পর্যন্ত কবে কোন পরীক্ষা হবে তার কর্মসূচি) কারণে শিক্ষাবর্ষ শেষ না হতেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে চূড়ান্ত পরীক্ষা। ফলে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের অধিকাংশ শিক্ষার্থীকেই প্রাইভেট পড়ার ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। বিশেষ করে বাণিজ্য ও বিজ্ঞান এবং অর্থনীতি, ইংরেজির মতো বিষয়ে বেশি প্রাইভেট পড়তে হয়।
তবে কলেজের অধ্যক্ষ আবু বকর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, প্রাইভেট পড়ার বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তিনি বলেন, নিয়মিত ক্লাস করলে প্রাইভেট না পড়লেও চলে। তবে এটা ঠিক যে ক্র্যাশ প্রোগ্রামের কারণে একটি শিক্ষাবর্ষ এক বছরে শেষ হচ্ছে না। এর মধ্যেও তাঁরা নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের একজন ছাত্র প্রথম আলোকে বলেন, বিভাগের এক শিক্ষকের কাছে তাঁরা ব্যাচ করে ‘বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা’ বিষয়ে প্রাইভেট পড়ছেন। তাঁদের ৩০০ টাকা (মাসে ১২ দিন) করে দিতে হয়। ব্যাচে কমপক্ষে ১৫ জন পড়েন। আরও দুটি ব্যাচে কমপক্ষে ৩০ জন শিক্ষার্থী পড়ান এই শিক্ষক।
শিক্ষক ছাড়া ‘বড় ভাই’দের কাছেও প্রাইভেট পড়েন বলে জানালেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাঁরা বলেন, নিয়মানুযায়ী বছরে ২১০ দিন ক্লাস হওয়ার কথা। এখন ১০০ দিনেও ক্লাস হয় না। আর শিক্ষক-সংকট তো রয়েছেই।
কলেজ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর এই কলেজের জন্য শিক্ষক আছেন মাত্র ১০৬ জন। ১৪৬টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ৪১টি ফাঁকা। ১৫টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হলেও ছয়টি বিভাগে অধ্যাপকের পদই নেই। বিভাগগুলো হলো দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস (পদ নেই তবু একজন অধ্যাপক সংযুক্ত), ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, হিসাববিজ্ঞান (পদ না থাকলেও একজন সংযুক্ত) এবং আরবি ও ইসলাম শিক্ষা। বাংলা, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে পদ থাকলেও অধ্যাপক নেই।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একজন শিক্ষক বলেন, যখন ছাত্রছাত্রীরা দেখে প্রায়ই ক্লাস হয় না, তখন তারা ক্লাসের দিনেও আসতে চায় না। শিক্ষার্থীদের ঐকান্তিক চেষ্টা না থাকলে সনদ পেত কিনা সন্দেহ এই শিক্ষকের।
শিক্ষকতার পাশাপাশি দীর্ঘদিন শিক্ষা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়া কতটা যৌক্তিক এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই স্তরের একজন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়তে হবে এটা কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। যদি শ্রেণিকক্ষে ৭০ শতাংশ উপস্থিতি কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা যায় ও শিক্ষকেরা ঠিকমতো পড়ান, তাহলে প্রাইভেটের প্রয়োজন হয় না।
পরিবহন খাতের টাকা প্রশ্নপত্র ও খাতা আনা-নেওয়ার কাজে ব্যয়: কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পরিবহন ও যাতায়াত তহবিল বাবদ ৫০ টাকা করে আদায় করে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য নেই বাস। ছাত্র সংসদ না থাকলেও এ খাতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বছরে ২৫ টাকা করে আদায় হয়।
ব্যবস্থাপনা বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী গোবিন্দ রায় প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন খাতে টাকা আদায় করা হলেও সেসব খাতের সুবিধা তাঁরা পান না। তিনি বলেন, উন্নয়ন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, বিবিধসহ বিভিন্ন খাতেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় হয়। কিন্তু তাঁরা এসবের পর্যাপ্ত সুবিধা পান না।
অবশ্য কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও খাতা আনা-নেওয়ার খরচের অর্থ পরিবহন তহবিল থেকে ব্যয় হয়। ছাত্র সংসদের টাকা নেওয়া হলেও আলাদা তহবিলে জমা থাকছে। অন্যান্য খাতের টাকাও যথাযথ খাতে ব্যয় হচ্ছে।