উচ্চ আদালতে এখনো অবহেলিত বাংলা

.
.

দেশের নিম্ন আদালতের বিচারকাজে বাংলার ব্যবহার বাড়লেও উচ্চ আদালতে এখনো অবহেলিত। সুপ্রিম কোর্টে এখনো বেশির ভাগ রায় বা আদেশ ইংরেজিতে দেওয়া হয়। খুব কমসংখ্যক রায় বা আদেশ বাংলায় দেওয়া হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও আইনজীবীরা বলছেন, উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার না বাড়ার মূলে রয়েছে প্রথাগত মানসিকতা। আইনজীবীরা যেমন প্রথা ভেঙে বাংলায় আবেদন লিখতে চান না, তেমনি বিচারকেরাও কষ্ট করে বাংলায় রায় দিতে চান না। এই প্রথা ভাঙতে তাঁদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।
উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার যে সীমিত, তা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে স্পষ্ট। গত বছরের ৩ ডিসেম্বর ‘মাতৃভাষা ও দেশীয় সংস্কৃতি’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘নিম্ন আদালতে বিচারকাজ ইতিমধ্যে বাংলায় চালু হয়েছে, উচ্চ আদালতেও এটা হওয়া দরকার। আমাদের কয়েকজন বিচারক অবশ্য বাংলায় রায় দিচ্ছেন। আমিও চিন্তা করছি দু-একটি রায় বাংলায় দেওয়ার জন্য।’
জানা গেছে, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ছাড়া আর কোনো বিচারপতি নিয়মিত বাংলায় রায় বা আদেশ দেন না। ২০১০ সালে নিয়োগের পর থেকে তিনি সব আদেশ ও রায় বাংলায় দিয়েছেন, যার সংখ্যা প্রায় তিন হাজার।
সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (বিচার ও প্রশাসন) সাব্বির ফয়েজ প্রথম আলোকে বলেন, নিম্ন আদালতের সিংহভাগ রায় ও আদেশ এখন বাংলায় হচ্ছে। তিনি বলেন, বিধি অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের দাপ্তরিক কার্যক্রমে বাংলা বা ইংরেজি যেকোনো ভাষা ব্যবহার করা যায়। কোন ভাষায় রায় বা আদেশ দেওয়া হবে, তা সম্পূর্ণ বিচারকের ব্যক্তিগত বিষয়।
সুপ্রিম কোর্টে এ পর্যন্ত কতগুলো রায় ও আদেশ বাংলায় দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানা গেছে, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান, বিচারপতি মো. আবু তারিক, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল প্রমুখ বেশ কয়েকটি মামলার রায় বাংলায় দিয়েছেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের আলোচিত রায়টি বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বাংলায় লিখেছেন। দু-একটি মামলার রায় বাংলায় দিয়েছেন, এমন বিচারপতি আছেন আরও কয়েকজন।
বাদী, বিবাদী, আইনজীবী ও বিচারক—সবাই যেখানে বাঙালি, সেখানে বাংলায় রায় হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবার আগে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। ইংরেজিতে কথা বলতে বা লিখতে পারলে আমরা গৌরব বোধ করি।’
১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সব স্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে।...সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ বাহাত্তরের সংবিধানেও বঙ্গবন্ধুর ওই বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যায়। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দেওয়া হয়। আইনগতভাবে বাংলাদেশে বিকল্প কোনো দাপ্তরিক ভাষাও নেই।
ঔপনিবেশিক আমলের ধারাবাহিকতায় অবশ্য তারপরও দেশের সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়নি। ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন নামে একটি আলাদা আইন করা হয়। ওই আইনের ৩ (১) ধারায় বলা হয়, একমাত্র বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া এ আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনগত কাজ অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।
ওই আইনের পর নিম্ন আদালতে ব্যাপক হারে বাংলার ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের এক রায়ে তা আবার থমকে যায়। ১৯৯১ সালে একটি রিট মামলার রায়ে (হাশমত উল্লাহ বনাম আজমিরি বিবি ও অন্যান্য; ৪৪ ডিএলআর) হাইকোর্ট বলেন, দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ (২) ধারায় অধস্তন আদালতের ভাষা নিয়ে সরকার কোনো ঘোষণা দেয়নি। তাই বাংলা ভাষা প্রচলন আইন থাকা সত্ত্বেও দেওয়ানি আদালতে ইংরেজি চালু রাখা যাবে। হাইকোর্টের ওই রায় চ্যালেঞ্জ করে কেউ আপিল বিভাগে যাননি। ২০১১ সালে আইন কমিশন দেওয়ানি কার্যবিধির ওই ধারাটি সংশোধনের জন্য সরকারকে সুপারিশ করে। সেই সুপারিশ আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রয়াত বিচারপতি আমীরুল ইসলাম চৌধুরী সর্বপ্রথম সুপ্রিম কোর্টে বাংলায় রায় দেন। আর আইনজীবী সামছুদ্দিন ও ভাষাসৈনিক গাজীউল হক সব আদালতে বাংলায় বক্তব্য রাখা ও আবেদন লেখা শুরু করেন। গাজীউল হক উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আইনবিষয়ক বই বাংলায় লিখেছেন এবং অনুবাদ করেছেন। আর বাংলায় রায় দেওয়ার জন্য বিচারকদের সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছেন প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের মধ্যে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক, বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, আপিল বিভাগের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ বাংলায় বেশ কয়েকটি রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে বিচারপতি খায়রুল হক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল, স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ প্রভৃতি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় বাংলায় দিয়েছেন।
উচ্চ আদালতে এখনো বাংলা অবহেলিত—এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিজের ভালো যদি কেউ না বোঝে, তাহলে কে বুঝাবে?’
প্রায় ৩০০ বছর আগেও যুক্তরাজ্যের আদালতের দাপ্তরিক ভাষা ছিল ফ্রেঞ্চ ও ল্যাটিন। ওই সময় সেখানকার আদালতে ইংরেজিতে শুনানি হলেও সব নথি লেখা হতো ল্যাটিনে। ১৭৩০ সালে ‘প্রসিডিংস ইন কোর্টস অব জাস্টিস অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের সব আদালতের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা হয়। এর ফলে আদালতের সিদ্ধান্ত বোঝা বিচারপ্রার্থীদের জন্য সহজ হয়ে যায়, আগে আইনজীবী ছাড়া যা বোঝা সম্ভব ছিল না। তবে ইংরেজিতে আইনি পরিভাষায় ল্যাটিনের প্রভাব এখনো আছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মতে, উচ্চ আদালতে আইনগত বিষয়ের বিচার বেশি হয়, তাই এখানে ইংরেজিতে বেশি রায় হয়। তবে এটিকে বাংলায় রায় হওয়ার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা মনে করেন না রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘কষ্ট হলেও চাইলেই বাংলায় রায় দেওয়া যায়। তবে বাংলায় রায় দিতে আমাদের হয়তো কিছুটা হীনম্মন্যতাও কাজ করে। আর আমরা তো এখনো ঔপনিবেশিক ভাবধারা থেকে ফিরে আসতে পারিনি।’