সুযোগ থাকলেও তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষার বিধান নেই

জাহাজ থেকে খালাস করা হচ্ছে পুরোনো লোহা। ছবিটি সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের ৩ নম্বর জেটি থেকে তোলা l প্রথম আলো
জাহাজ থেকে খালাস করা হচ্ছে পুরোনো লোহা। ছবিটি সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের ৩ নম্বর জেটি থেকে তোলা l প্রথম আলো

আমদানি করা পুরোনো ইস্পাত বা লোহার পণ্যে তেজস্ক্রিয়তার দূষণ রয়েছে কি না, চট্টগ্রাম বন্দরে তা পরীক্ষা করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাধ্যতামূলক না হওয়ায় এই পরীক্ষাটি করা হয় না। ফলে আমদানি করা লোহার পণ্যে সহনীয় মাত্রার বেশি তেজস্ক্রিয়তা রয়েছে কি না, সে বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই।
আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী, পুরোনো লোহার পণ্য আমদানির সময় রপ্তানিকারক দেশের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থমুক্ত সনদ লাগবে। শুধু এই সনদ থাকলে বন্দর দিয়ে অনায়াসে খালাস করা যাবে এসব পণ্য। তবে একই ধরনের সনদ থাকার পরও গুঁড়া দুধ, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য খালাসের সময় পরমাণু শক্তি কমিশনে তেজস্ক্রিয়তার পরীক্ষা করতে হয়। সেখান থেকে ইতিবাচক ফল আসার পর পণ্য খালাস করা হয়।
পরমাণু শক্তি কমিশনের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের পরিচালক বিজ্ঞানী মাসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, সনদ নিয়ে আমদানি করার পরও গুঁড়া দুধ, ওষুধসহ কয়েকটি পণ্য দেশে পরীক্ষার পর সহনীয় মাত্রার বেশি তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হয়েছিল। তিনি বলেন, পুরোনো লোহার পণ্যে তেজস্ক্রিয়তা থাকলে সেটি গলিয়ে রড বানানোর পরও তেজস্ক্রিয়তার দূষণ থেকে যাবে।
তেজস্ক্রিয়তার দূষণে মানবদেহের ত্বক পুড়ে যাওয়া, কোষ ধ্বংস হওয়াসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি এই দূষণ থেকে ক্যানসারও হতে পারে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
পুরোনো লোহার পণ্য খালাসের আগে আরও একবার তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা করা উচিত বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক অরুণ কুমার দেব। তিনি বলেন, আমদানি করা লোহার ছোট-বড় টুকরায় তেজস্ক্রিয়তা দূষণ থাকতে পারে। ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিপর্যয়ের পর অনেক দেশেই পুরোনো লোহা ও ইস্পাত আমদানির পর নিজ দেশের সুরক্ষার জন্য আবার পরীক্ষা করাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, খাদ্যপণ্য আমদানির পর তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা করার বিধান থাকলে পুরোনো লোহা পরীক্ষা করতে অসুবিধা থাকার কথা নয়। আর এসব পরীক্ষা করার ব্যবস্থা দেশেই রয়েছে।
বন্দর সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি করার পথে ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে পুরোনো ইস্পাত পণ্যের একটি চালানে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হয়। অথচ ওই পণ্য রপ্তানির সময় তাতে সহনীয় মাত্রার বেশি তেজস্ক্রিয়তা নেই বলে সনদ দিয়েছিল একটি আন্তর্জাতিক পরিদর্শন সংস্থা।
পণ্য প্রবেশ ও খালাসের জন্য ব্যবহার করা বন্দরের ১১টি ফটকের মধ্যে পাঁচটিতেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পারমাণবিক ও তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। তবে জাহাজ থেকে খালাসের পর পুরোনো ইস্পাত বা লোহার পণ্যবাহী ট্রাককে এসব ফটক ব্যবহার করতে হয় না।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হেদায়েতুল্লা আল মামুন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এসব পণ্য (পুরোনো লোহা) আমদানির আগে একবার তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা করা হয়। দেশে আনার পর আবারও একই পরীক্ষা করা হলে আমদানি-প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তবে কোনো পণ্যে তেজস্ক্রিয়তা থাকতে পারে, এমন সন্দেহ তৈরি হলে সেটি রাজস্ব বোর্ড বা কাস্টম কর্তৃপক্ষের পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ আছে।
বন্দর সূত্র জানায়, হঠাৎ দেশে পুরোনো লোহার পণ্য আমদানি বেড়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২ লাখ ৫৪ হাজার টন পুরোনো লোহার পণ্য আমদানি করা হয়েছিল। গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৯১ হাজার টনে। এত দিন কনটেইনারে আমদানি হতো এসব পণ্য। তবে গত বছরের জুলাই থেকে খোলা (বাল্ক) জাহাজে বোঝাই করে পুরোনো লোহা আমদানি করা হচ্ছে। গত জুলাই থেকে গত ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাপান, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সোয়া দুই লাখ টন পুরোনো লোহা আমদানি করা হয়েছে। এসব পণ্য তেজস্ক্রিয়তার ফটক ব্যবহার না করেই খালাস করা হয়েছে।
আমদানি করা পুরোনো লোহার পণ্যে তেজস্ক্রিয়তা দূষণ রয়েছে কি না, তা দেশে নতুন করে পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জানতে চাইলে কাস্টমস কমিশনার হোসেন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত করার জন্য বন্দরে নির্ধারিত ফটক আছে। রপ্তানির সময় এসব ফটক ব্যবহার করে পণ্য জাহাজে তোলা হয়। যদি বিধি করা হয়, তাহলে সব ধরনের আমদানি পণ্যও এসব ফটক দিয়ে বের করা যেতে পারে।
২০১৪ সালের ১১ আগস্ট আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জাপান থেকে ২০ টন পুরোনো লোহার টুকরা আমদানি করে দক্ষিণ কোরিয়া। এর ২০ কেজিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হয়।
২০১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জাপান থেকে আমদানি করা পুরোনো লোহার পণ্যে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত করে সে দেশের একটি সংস্থা।
সম্প্রতি সরেজমিনে বন্দরে দেখা যায়, জাপান থেকে এমভি ওশান গ্লোরি জাহাজে আমদানি করা পুরোনো লোহা খালাস হচ্ছে জেটিতে। পাশের আরেকটি জেটিতে এমভি সোয়ান জাহাজ থেকেও খালাস হচ্ছিল একই পণ্য। জাহাজ থেকে ট্রাকে বোঝাই করার পর এসব পণ্য বন্দরের ১ নম্বর ফটক দিয়ে সরাসরি কারখানায় নেওয়া হচ্ছে। রড তৈরির জন্য এসব পুরোনো লোহার পণ্য আমদানি করছেন রড তৈরির কারখানার মালিকেরা।
কাস্টম সূত্র জানায়, এমভি ওশান গ্লোরি জাহাজের পণ্যের তেজস্ক্রিয়তার সনদ দেয় জাপানের ‘এনকেকেকে’ নামের একটি আন্তর্জাতিক পরিদর্শন সংস্থা। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই পণ্যে কোনো বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, গ্যাস সিলিন্ডার, অস্ত্র, বোমা, তেজস্ক্রিয়তার দূষণযুক্ত বা কোনো বিস্ফোরক পদার্থ নেই।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক মো. মোফাজ্জল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন ও পারমাণবিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিধিমালা অনুযায়ী জনসাধারণের জন্য নির্ধারিত বিকিরণসীমা বছরে এক মিলিসিভার্ট (বিকিরণের একক)। এর বেশি হলে অর্থাৎ তেজস্ক্রিয়তা থেকে নির্গত বিকিরণের মাত্রার ওপর মানুষের ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করে।