বরিশালে পুলিশের 'গ্রেপ্তার-বাণিজ্য'

বরিশালের চর কাউয়ায় গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। তবে পুলিশ বলছে, এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন। তার পরও কেউ প্রমাণ করতে পারলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে একজন কলেজছাত্র খুন এবং পরদিন শুক্রবার ১৫টি হিন্দু বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। দুই মামলায় ইতিমধ্যে ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ঘটনার ছয় দিন পেরিয়ে গেলেও নিজের ভিটায় ফিরতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। নতুন ঘর তৈরি তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত ভস্মীভূত ধ্বংসাবশেষই সরানো সম্ভব হয়নি। তাই এখনো তাদের উদ্বাস্তুর মতো প্রতিবেশীর বাড়িতে রাত কাটাতে হচ্ছে।

বরিশাল জেলা প্রশাসন বলছে, ধ্বংসাবশেষ সরানোর জন্য আজ বৃহস্পতিবার স্কাউট সদস্যদের সেখানে পাঠানো হবে। তারা এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করবে।

গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ: পারভেজ গাজীকে হত্যার মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে নয়জন ও অজ্ঞাত কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। আর হিন্দু বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় অজ্ঞাত দেড় হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে।

হিন্দু পরিবারগুলো অভিযোগ করেছে, হত্যা মামলায় নিরীহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আগুনে সর্বস্ব হারানো বীথি রানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘর তুলমু কি? চিন্তায়ই তো বাঁচি না। ঘটনার দিন আমার স্বামী সুমন চন্দ্র দাস ছিল বরিশাল। কিন্তু পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে।’

শান্ত চন্দ্র হালদারের বাবা শ্যামলাল বলেন, ‘আমার ছেলে চানমারীতে পাহারাদারের কাজ করত। পুলিশ বরিশাল শহর থেকে তাকে খুনের মামলায় গ্রেপ্তার করেছে। আমি এলাকার চেয়ারম্যান, পুলিশসহ সবার কাছে গেছি। কিন্তু ছেলেকে পুলিশ ছাড়ছে না।’

পারভেজ গাজী হত্যা মামলায় তাঁর বাবা সেলিম গাজী আদালতে যে মামলা করেছেন, সেখানে সুমন দাসের নাম থাকলেও শান্ত চন্দ্র হালদারের নাম নেই। নিহত পারভেজ গাজীর ছোট ভাই পাভেল গাজীও প্রথম আলোর কাছে ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময় শান্তর নাম বলেননি।

হিন্দু পরিবারগুলোর অভিযোগ, সেদিন প্রকাশ্য দিবালোকে কারা হিন্দু বাড়িতে আগুন দিয়েছিল, তা সবাই দেখেছে। কিন্তু পুলিশ মূল লোকদের গ্রেপ্তার করছে না। তারা শুনেছে, তাদের অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে পুলিশ।

একাধিক মুসলিম পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ মূল পরিকল্পনাকারীদের না ধরে যাকে-তাকে আসামি করার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করছে।

বরিশালের সদ্য সাবেক মেয়র শওকত হোসেন গতকাল সকালে নিহত পারভেজ গাজীর বাড়িতে যান। সেখানে উপস্থিত মো. খোকন নামের এক যুবক তাঁর কাছে অভিযোগ করেন, পুলিশ তাঁকে বিনা কারণে আটক করেছিল। পরে ১০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পান তিনি। ওই বাড়িতে আরও কয়েকজন যুবক অভিযোগ করেন, জনপ্রতি পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পুলিশকে দিয়ে এলাকায় ফিরেছেন তাঁরা।

পারভেজ গাজীর বাড়ি থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু বাড়িগুলোতে গিয়ে ১৫টি পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতা দেন শওকত হোসেন। এ সময়ও হিন্দু পরিবারগুলো তাঁর কাছে গ্রেপ্তার আতঙ্কের কথা জানায়।

শওকত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘হিন্দু-মুসলমান সবাই গ্রেপ্তারের আতঙ্কের কথা জানিয়েছে। গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে অনেকের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে, এমন অভিযোগও আমার কাছে অনেকে করেছে। অমি বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বলেছি, নিরীহ ব্যক্তিদের যেন হয়রানি করা না হয়।’

জানতে চাইলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘টাকা নিয়ে কাউকে আসামি করা বা কাউকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন। পুলিশের বিরুদ্ধে এটি একটি অপপ্রচার।’ শান্ত চন্দ্র হালদারকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে তিনি বলেন, মামলা হওয়ার আগেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এখন ঘটনার তদন্ত চলছে। তিনি জড়িত না থাকলে অভিযোগপত্রে তাঁর নাম থাকবে না।

অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নতুন করে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি জানিয়ে ওসি বলেন, ‘আমরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত মূল পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি এবং অনেক দূর অগ্রসর হয়েছি।’

বরিশাল মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) এ টি এম মুজাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ হত্যার ঘটনায় পাঁচজনকে এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ২১ জনকে আটক করা হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক দিনে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। কাজেই গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের অভিযোগ করা মোটেও ঠিক নয়। তার পরও থানার কোনো পুলিশের বিরুদ্ধে যদি এমন অভিযোগ পাওয়া যায় যে কাউকে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করছে, তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন,                ‘আমি অনুরোধ করছি, কারও কাছ থেকে এভাবে টাকা নেওয়া হলে আমার কাছে আসুন। আমি তাঁর পরিচয় গোপন রেখে দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’

গতকাল বেলা সাড়ে তিনটায় জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল আলম চর কাউয়ার মাতৃ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সুধী সমাবেশ করেন। তিনি সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সবাইকে অনুরোধ করেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো যাতে ঘর তুলে নিজের ভিটায় ফিরতে পারে, সে ব্যাপারে সহযোগিতা দেওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। জেলা প্রশাসক আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত গোপাল চন্দ্র হালদার ও তাঁর স্ত্রী পূর্ণিমা রানীকে দুটি গরু দেন। আগুনে তাঁদের দুটি গরু পুড়ে মারা যায়।

অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের তদন্তকাজ এখনো চলছে বলে জানান কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, প্রাথমিক তদন্তের সময় এলাকাবাসী বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য থাকলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা রোধ করা যেত। ২২ নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।