ছেলে-মা-বোনসহ ৪ জনকে কুপিয়ে হত্যা

মাদকের নেশা পেয়ে বসেছিল তাঁকে। কিন্তু তাঁর কাছে ছিল না মাদক কেনার টাকা। মায়ের কাছে টাকা চেয়েও পাননি। এ নিয়ে বাগিবতণ্ডার একপর্যায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে একে একে নিজের ছেলে, মা, বোন ও এক আত্মীয়কে হত্যা করেন। সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নের দক্ষিণ পুরানপাড়া গ্রামে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ ধারালো অস্ত্রসহ ফরুখ মিয়া (৩৪) নামের ওই ব্যক্তিকে আটক করেছে।

নিহত ব্যক্তিরা হলেন ফরুখের মা শামসুন্নাহার (৫০), ছেলে তানভির আহমদ (৪), বড় বোন নাজমিন নাহার (৩৬) ও আত্মীয় হনুফা বেগম (৭০)। চারজনের লাশ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পুলিশ ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফরুখ পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি মাদকাসক্ত। এ কারণে তাঁর স্ত্রী সন্তানকে রেখে বাবার বাড়ি থাকেন।

গতকাল ভোর থেকে তিনি মাদক নেওয়ার চেষ্টা করেন। নিজের কাছে টাকা না থাকায় মায়ের কাছে টাকা চান। ওই সময় মা শামসুন্নাহার টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। একই সঙ্গে মাদক নিলে আবার পুলিশে দেবেন বলে তাঁকে সতর্ক করেন। এ নিয়ে ফরুখ ঘরে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকেন এবং মা ও বোনের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করেন।

একপর্যায়ে বেলা একটার দিকে রান্নাঘরে গিয়ে ধারালো অস্ত্র (বাইশখান) দিয়ে মা শামসুন্নাহারকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। এ অবস্থায় মাকে বাঁচাতে বড় বোন নাজমিন এগিয়ে গেলে তাঁকেও এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন ফরুখ। দুজনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করতে দেখে ফরুখের আত্মীয় হনুফা এগিয়ে যান। একইভাবে তাঁকেও কুপিয়ে দরজার সামনে অবস্থান নেন তিনি। খবর পেয়ে প্রতিবেশীরা থানায় খবর দিলে বেলা দেড়টার দিকে পুলিশ আসে। পুলিশ সদস্যদের বাড়ির সামনে দেখে ফরুখ ঘর থেকে তানভিরকে উঠানে নিয়ে কোপাতে থাকেন। এ সময় পুলিশ তাঁকে ধরতে এগিয়ে গেলে তিনি বাইশখান ফেলে পালানোর চেষ্টা করেন। এলাকাবাসী ও পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তাঁকে ধরে।

ফরুখের ছোট ভাই জামাল আহমদ জানান, মাদকাসক্তির কারণে ফরুখকে তিন দফায় পুলিশে সোপর্দ করেছে তাঁদের পরিবার। সর্বশেষ কারাগার থেকে মুক্তির পর তিনি অধিকাংশ সময় ঘরেই থাকতেন। ঝগড়াঝাঁটি থেকে তাঁর মাথায় খুনের নেশা চেপে বসবে—এটি তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি।

গোলাপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ফরুখ মাদকাসক্ত। পরিবারের সদস্যরা অতিষ্ঠ হয়ে তাঁকে তিনবার থানায় সোপর্দ করেছিলেন। সর্বশেষ দুই সপ্তাহ আগে তাঁকে থানায় সোপর্দ করা হয়। পুলিশ সহিংসতার একটি মামলায় তাঁকে সন্দেহভাজন আসামি দেখিয়ে গ্রেপ্তার করেছিল। পরে তাঁর মা জামিন নিয়ে ছাড়িয়ে আনেন। গতকাল ঘটনার সময় ফরুখের ভাগ্নি ঘরে ছিল। সে কৌশলে ঘর থেকে বের হয়ে প্রতিবেশীদের হত্যার বিষয়টি জানায়। ঘটনার পর এলাকায় প্রচুর লোক ওই বাড়িতে ভিড় করেছেন। ফরুখের বাড়িতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নাসিরুল হক বলেন, ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই বিমূঢ়। যে মা তাঁকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন, সেই মাও তাঁর হাত থেকে রেহাই পেলেন না।

জানা গেছে, মৃত আবদুল আজিজের চার ছেলে ও দুই মেয়ে। ভাইদের মধ্যে ফরুখ সবার বড়। তাঁর ছোট দুই ভাই প্রবাসী। মাদকাসক্তির কারণে তাঁকে পার্শ্ববর্তী গ্রামে বিয়ে করানো হয়। কিন্তু বিয়ের এক বছর পর থেকে আবার তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল বলেন, মাদকাসক্তি নিরাময়ের জন্য বিয়ে বা পুলিশে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। এ ধরনের লোক সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত ও মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যায়। মনে করে, পরিবারের সদস্যরা তাঁদের অমঙ্গল চায়। তারা রাগ-ক্রোধের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং ভয়ংকর দানবে পরিণত হয়। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু করতে পারে। এদের সর্বোচ্চ চিকিৎসার উদ্যোগ নিতে হবে। স্বজন, পরিবারের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের তাদের সহায়তা এগিয়ে আসতে হবে। একবার চিকিৎসা ব্যর্থ হলেও চিন্তার কিছু নেই। বারবার চেষ্টা করতে হবে।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক বিভাগের চিকিৎসক এস কে রয়েলও একই মতামত জানান। তিনি বলেন, এ ধরনের ব্যক্তির কাজে বাধা দিলে সে যেকোনো ধরনের ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে।