স্বেচ্ছাচারিতার জয়!

স ং বা দ বি শ্লে ষ ণ
স ং বা দ বি শ্লে ষ ণ

আপাতত স্বেচ্ছাচারিতা ও কূটকৌশলেরই জয় হলো। বিরোধী দলকে বাইরে রাখার এই কৌশল বুমেরাং হবে কি হবে না—সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দলের ভবিষ্যৎ মনোনয়ন ও নেতৃত্বের প্রতিও বার্তা গেল। হাস্যকর হলো, মন্ত্রিসভাকে ঝেড়েমুছে ‘অনির্বাচিত’মুক্ত করা হয়েছে। ২৯ জনই এখন নির্বাচিত।

মন্ত্রী ও বিচারপতির সংখ্যা বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় নির্ধারিত হয়। ২০০৪ সালে ভারত সংবিধান সংশোধন করেছে। সংসদের আসন যত, মন্ত্রী হবে তার অনধিক ১৫ ভাগ। ৫৪৩ জনের লোকসভার বিপরীতে ৮১ জন মন্ত্রী থাকার কথা। বর্তমানে চারজন কম আছেন। বাংলাদেশের ৩০০ জনে আসে ৪৫। এবার দেখা গেল, মন্ত্রীর মর্যাদায় অনির্বাচিত উপদেষ্টার সংখ্যা আরও তিনজন বাড়ল। উপদেষ্টা এখন ১০। তাই ২৯ জনের ছোট মন্ত্রিসভার সংখ্যা আসলে ৩৯। তথাকথিত ছোট মন্ত্রিসভার কল্যাণে এবার তবু ভারতকে অনুকরণ করা সম্ভব হলো। তবে তা-ও সাময়িক। হয়তো মন্ত্রিসভাকে ঘিরে ধরাধরি ও ভাগাভাগির নাটক চলবে। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত এই মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের সুযোগ থাকবে।’ এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর জন্য সংবিধান বড়ই লাগসই। তিনি চাইলে পারবেন। ভোটের দিনেও নতুন মন্ত্রী নিতে পারবেন। সংসদের বৈঠকও চালাতে পারবেন। বাস্তবে তিনি নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেবেন। বলবেন এটাই রুটিন। সংবিধান তাঁকে বাধা দেবে না।

এবার সংসদীয় রেওয়াজের লঙ্ঘন ঘটল। কারণ, মন্ত্রিসভা দিয়ে সংসদের চরিত্র পাল্টে দেওয়া হয়েছে। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে সংখ্যালঘু আর সংখ্যালঘু দলটিকে সংখ্যাগরিষ্ঠে পরিণত করা হয়েছে। সংসদে আ.লীগ ও জাপার আসন ২৩০: ২৭। মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের

প্রতিনিধিত্ব হলো ২৩০ জনের বিপরীতে ২১ জন। জাপার ২৭ জনের বিপরীতে ছয়জন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের প্রতি ১১ জনে একজন মন্ত্রী। আর এরশাদের দলটির প্রতি সাড়ে চারজনে একজন মন্ত্রী।

নির্বাচনকালে বিশ্বের অন্যান্য সংসদীয় গণতন্ত্রে ‘সর্বদলীয়’ সরকার হয় না। তথ্যমন্ত্রী-বর্ণিত ‘বহুদলীয়’ সরকারও নয়। গতকাল যেটা ঘটল তার সঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্পর্ক নেই। কারণ, নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রশাসন, মন্ত্রিসভা বিভাগ, প্রতিরক্ষা দলীয় সভানেত্রীর কাছেই থাকল; বরং নতুন তোফা এল স্বরাষ্ট্র এবং আইন ও বিচার।

একটি কৌশলগত ক্ষমতা ভাগাভাগি হলো। ক্ষমতাকে স্থায়ীকরণের প্রবণতা প্রকাশ পেল। আর পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে সংখ্যালঘু এবং জাতীয় পার্টি সংখ্যালঘু থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে রূপান্তরিত হলো। এরশাদ নির্বাচনের আগেই ক্ষমতাবান হলেন।

আরও পরিহাস হলো, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কালীগঞ্জ আওয়ামী লীগের শ্রদ্ধাভাজন নেতা ছিলেন ময়েজউদ্দিন আহমেদ। তাঁকে হত্যার দায়ে দণ্ডিত আজম খানকে এরশাদ দ্রুত ছেড়ে দিয়েছিলেন। সারা দেশের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ক্ষোভে-দুঃখে ফেটে পড়েছিলেন। সেই নিহত নেতা ময়েজউদ্দিনের মেয়ে ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী। তিনি মেহের আফরোজ। বাবার আসন থেকেই সরাসরি নির্বাচিত হন। তিনি বাদ পড়েছেন। তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করলেন এরশাদের মহিলা কোটার সদস্য সালমা ইসলাম। ‘বিশ্ব বেহায়া’ প্রমাণ দিলেন, তিনি বেহায়া নন।

শপথ নেওয়ার পরপরই এটিএন বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ স্বীকার করেন, তাঁরা সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষি করেই মন্ত্রিত্ব নিয়েছেন। মন্ত্রিসভায় তাঁরা আরও বেশি পদ চেয়েছিলেন। তাঁর পানিসম্পদ মন্ত্রিত্ব নির্বাচনে কাজে আসবে না। মহাজোটের দুই ছোট শরিকের মধ্যে ইনুর হাতে তথ্য থাকলেও মেননের ডাক ও টেলিযোগাযোগ কোনো নির্বাচনী কাজে আসবে না। তবে অন্য সুবিধা থাকতে পারে।

সংসদে আওয়ামী লীগ আসনে যেমন ২৩০, তেমনি ভোটেও ৪৯ ভাগ। জাপা আসনে ২৭ হলেও ভোট খুবই কম। মাত্র ৭ ভাগ। মহাজোট মন্ত্রিসভায় প্রতি চারজন আওয়ামী সাংসদের মধ্যে একজন মন্ত্রী ছিলেন। জাপার ২৭ জন সাংসদের মধ্যে ছিলেন একজন মন্ত্রী। এটা কাল রাতারাতি পাল্টে গেল।

শেখ হাসিনার এই নির্বাচনী ‘ওয়ার কেবিনেট’ কার বিরুদ্ধে বর্ম পড়ল? সম্ভবত প্রাক্-নির্বাচনী জরিপগুলো বিবেচনায় নিয়ে তাঁর যুদ্ধংদেহী মনোভাব আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। প্রথম আলোর জরিপ কেবল নয়, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার জরিপও তাঁকে রাজনৈতিক পরাজয়ের দিকেই ইঙ্গিত করেছে।

ওই চিত্রের বাইরেও তাঁর রাজনৈতিক অবস্থাটি যথেষ্ট ধূসর। মোটামুটি নিরপেক্ষ ভাবমূর্তিসম্পন্ন কিংবা আওয়ামী লীগ-অনুগত নাগরিক সমাজের কারোরই ঠাঁই হলো না। শেখ হাসিনার সঙ্গে ঈষৎ ভিন্নমত পোষণ করার সামর্থ্য রাখেন এমন কেউ মন্ত্রিসভায় এলেন না। ব্যক্তি শেখ হাসিনার প্রতি শর্তহীন আনুগত্যের পরীক্ষায় এঁরা প্রায় প্রত্যেকে উত্তীর্ণ ও পরীক্ষিত। আর, আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ—দলে যাঁদের গুরুত্ব ছিল না, তাঁরা এখন গুরুত্বপূর্ণ। তাই পুনর্গঠন বেশি চমক দিয়েছে। বেশি আস্থা বাড়ায়নি। বরং এটাই বড় সত্য যে, সংসদীয় রেওয়াজ ব্যক্তির খেয়ালখুশির কাছে পরাস্ত হলো। আজ থেকে যে মন্ত্রিসভা যাত্রা শুরু করল, তা সংবিধানের চেতনায় আঘাত দিতে দিতে এগিয়ে যাবে।

সেনাছাউনিতে জন্ম নেওয়া এরশাদের সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী জাতীয় পার্টির কাছে বঙ্গবন্ধু, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগকে খাটো করা হয়েছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি কতটা নিচে নামালেন শেখ হাসিনা!

আর আনিসুল ইসলাম মাহমুদ শপথ নিয়েই বলেছেন, সংবিধান থেকে ধর্মবিষয়ক যে অংশ আওয়ামী লীগ ফেলে দিয়েছে, তা তাঁরা ফিরিয়ে আনবেন। এ বিষয়ে হেফাজতের সঙ্গে এরশাদ একমত।

উল্লেখ্য, আনিস মাহমুদ যে অংশটির কথা বলেছেন, সেটি ১৫তম সংশোধনীতে ফেলে দেওয়া হয়। এবং সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চার মূলনীতিকে প্রতিস্থাপন করা হয়। একে সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এর কোনো পরিবর্তন সংশোধনের অযোগ্য হবে। নতুন মন্ত্রীর এই বক্তব্য ‘রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ’।

সার্বিক বিচারে ২৯ সদস্যের ‘ছোট’ মন্ত্রিসভা গঠন তাই স্মরণকালের ইতিহাসে একটি বড় মাপের প্রহসন। শেখ হাসিনা লিখেছিলেন, শহীদ নূর হোসেনের বুকে-পিঠে স্বৈরাচার নিপাত যাক দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। নূর হোসেন তাঁর কাছে ‘দোয়া’ চেয়েছিলেন। এই ঘটনার ২২ বছর পরে শেখ হাসিনার ‘দোয়া’ নিয়ে সেই পতিত স্বৈরাচারের ছয় সহযোগী জাতির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেলেন। জাতি গণপদত্যাগ নাটকের পরে এরশাদের দোসরদের গণযোগদান নাটক দেখল। এই নাটকের ‘গোলাম হোসেন’ হলেন এখনো বামপন্থী রাশেদ খান মেনন।

কাজের কাজ বাকি থাকল। একচুল নড়ল না।