ময়লা পানির পাইপ দিয়ে গ্যাস ঢুকেছিল বাড়িটিতে

বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি
বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি

রাস্তার খননযন্ত্রের (এক্সকাভেটর) টানে তিতাস গ্যাসের পাইপ বিচ্ছিন্ন বা ঢিলা হয়ে যাওয়ায় সেখান থেকে বের হওয়া গ্যাস ঢুকেছিল বনানীর ওই বাড়ির ময়লা পানি নিষ্কাশনের পাইপে। ওই পাইপ দিয়ে গ্যাস ঢুকেছিল বিভিন্ন তলার টয়লেটে। আবদ্ধ ফ্ল্যাটে বাতাসে গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বিস্ফোরণ ঘটেছে।
রাজধানীর বনানীর ২৩ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাড়িতে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পৌনে দুইটার দিকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পেছনে এটিই কারণ বলে মনে করছেন বিস্ফোরক পরিদপ্তরের বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, তিতাসের পাইপ থেকে সময়মতো গ্যাস নির্গমন বন্ধ করা হলে ছয়তলা ওই ভবনে বিস্ফোরণ ঘটত না।
বিস্ফোরণে ভবনটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনটি থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের স্টর্ম সুয়ার প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রাস্তা খুঁড়তে বনানীর ওই এলাকায় খননযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছিল।
বনানীর ভবনটিতে বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে তিতাস গ্যাস, ফায়ার সার্ভিস ও পেট্রোবাংলা পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। গত মঙ্গলবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিস্ফোরক পরিদপ্তরের চারজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তাঁরা বলেছেন, বিস্ফোরণের ধরন ও কারণ নির্ণয় এবং বিস্ফোরক সম্পর্কে কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য পরিদপ্তরের উদ্যোগে এই পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়।
পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক মো. শামসুল আলম বিস্ফোরণ নিয়ে কাজ করছেন ২৮ বছর ধরে। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, খননযন্ত্রটি যখন মাটি টেনে তুলছিল, তখন গ্যাসের পাইপলাইনটিতে টান পড়ে এবং রাস্তার মাঝখানে সেটি বেঁকে যায়। কিন্তু গ্যাসপাইপের জোড়া বিচ্ছিন্ন বা ঢিলে হয় রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া ভবনগুলোর পানিনিষ্কাশন পাইপের কাছে। গ্যাসপাইপের জোড়া বিচ্ছিন্ন হওয়া বা ঢিলা হওয়া অংশ দিয়ে কিছু গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। আর কিছু গ্যাস ওই ময়লা পানি নিষ্কাশনের পাইপের মধ্যে জমা হয়। ওই পাইপ থেকে কাছেই সংযুক্ত ওই ভবনের ময়লা পানিনিষ্কাশনের পাইপ দিয়ে বিভিন্ন তলার টয়লেটে উঠে যায়। টয়লেটের দরজা সাধারণত বন্ধ থাকে। এ কারণে টয়লেটের বাতাসে গ্যাসের পরিমাণ সহজেই বেড়ে যায়, যা একপর্যায়ে বিস্ফোরণ ঘটায়।
শামসুল আলম বলেন, বাতাসে যদি দাহ্য গ্যাসের পরিমাণ ১ শতাংশ হয়, তবে তা শতভাগ বিস্ফোরক হয়ে যায়। এই মাত্রা ৮ শতাংশ পর্যন্ত হলে বিস্ফোরণ ঘটে। এর চেয়ে বাড়লে প্রথমে আগুন ধরে, তবে এ ক্ষেত্রে বিস্ফোরণ হয় না। সময়মতো গ্যাস নির্গমন বন্ধ করা হলে বনানীতে এমনটি ঘটত না। বনানীর ভবনটিতে বাতাসে গ্যাসের পরিমাণ ১ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে ছিল বলে বিস্ফোরণ ঘটেছে।
পরিদপ্তরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোনো ভবনে যদি গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়, তবে ভবনের সব বাতি, পাখাসহ বৈদ্যুতিক সামগ্রী বন্ধ করে দিয়ে বাসিন্দাদের দ্রুত ভবন ত্যাগ করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত জানাতে হবে। তবে জনসচেতনতার পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় থাকাও জরুরি।
ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির ছয়টি ফ্ল্যাটের মালিক শামসুল আলম বলেন, রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া পানিনিষ্কাশনের পাইপটি দেড় ফুট ব্যাসের। এর সঙ্গে ভবনের ময়লা পানি নিষ্কাশনের পাইপ সংযুক্ত। তিনি বলেন, ঘটনার আগের তিন দিন ধরে বাসার সামনে গ্যাস বের হচ্ছিল। তিন দফা তিতাস গ্যাসকে বিষয়টি জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সর্বশেষ জানানো হয়েছিল বিস্ফোরণের তিন ঘণ্টা আগে।
গুলশান, বনানী ও বারিধারার জলাবদ্ধতা নিরসনে উত্তর সিটি করপোরেশন পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা উন্নত করার অংশ হিসেবে ওই এলাকায় স্টর্ম সুয়ার নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ওই প্রকল্পের আওতায় রাস্তা খনন করা হয়।
এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের সঙ্গে দেখা করেছেন ভবনটির ফ্ল্যাট মালিকেরা। মেয়র ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়ে যথাসাধ্য চেষ্টার আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁরা বলেছেন, ভবনটি মেরামতের কোনো সুযোগ নেই। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে ভূমিকম্প হলে সবকিছু ঝুর ঝুর করে পড়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে এসব ফ্ল্যাটও আর কেউ কিনবে না। তাই পুরো ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন ডেভেলপারের সঙ্গে কথাও হয়েছে।