মুক্তিযোদ্ধার জীবন চলে রিকশা চালিয়ে

গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার কামারপাড়া ইউনিয়নের পুরান লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা মফিউজ্জামান (৬১)। এই বয়সেও তাঁকে রিকশাভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে।
গত বুধবার সকালে মফিউজ্জামানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এক শতক বসতভিটায় দোচালা ছোট্ট একটি টিনের ঘর। ঘরে দুটি চৌকি। এক ঘরেই স্ত্রী, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস। ঘরসংলগ্ন আঙিনায় রান্নার কাজ চলছে। এ সময় কাজে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মফিউজ্জামান। তিনি বলেন, ‘যা দেখছেন, এ ছাড়া আমার কোনো সহায়-সম্বল নেই।’
মফিউজ্জামানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁর বাবা রোস্তম আলী ছিলেন দিনমজুর। বাবা মারা গেছেন। মা হালিমা বেগমও নেই। ছয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মফিউজ্জামান সবার বড়। জীবিকার তাগিদে ১৫ বছর বয়সে তাঁকে দিনমজুরের কাজ বেছে নিতে হয়। সকালে দিনমজুরের কাজ করতেন ও বিকেলে গাভির দুধ বিক্রি করতে জেলা শহরে যেতেন। ১৯৭১ সালে গাইবান্ধা সদর উপজেলার দক্ষিণ চাপাদহ গ্রামের জহির উদ্দিনের মেয়ে জহুরা বেগমের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের দেড় মাস পরই শুরু হয় স্বাধীনতাযুদ্ধ। একদিন বিকেলে শহরে দুধ বিক্রি করতে যান। তাঁকে দেখে দুধ নেওয়ার কথা বলে পাকিস্তানি সেনারা বর্তমান গাইবান্ধা শাহ আবদুল হামিদ স্টেডিয়াম মাঠে ডেকে নিয়ে যায়। তাদের ক্যাম্পে গিয়ে মফিউজ্জামান দেখেন, বিবস্ত্র অবস্থায় কয়েকজন নারী বসে আছেন। তাঁদের মধ্যে এক নারী মফিউজ্জামানকে ক্যাম্প থেকে চলে যেতে বলেন। এরপর তিনি ক্যাম্প থেকে কেটে পড়েন। সেখান থেকে ফিরে নববধূ ও পরিবারের কাউকে না জানিয়ে ভারতের মানকারচরে প্রশিক্ষণে যান।
মানকারচরে ৪০ দিন প্রশিক্ষণের পর মফিউজ্জামান ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামেন। তিনি ফুলছড়ির ফুলছড়িঘাট ও সাদুল্যাপুরের মাদারগঞ্জ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধে অংশ নেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার দিনমজুরের কাজ শুরু করেন তিনি। দিনমজুরের আয় দিয়ে সংসার চলে না। ১৯৭৪ সাল থেকে ভাড়ায় রিকশাভ্যান চালানো শুরু করেন। এলাকায় ভাড়া কম হলে রাজশাহী ও সিলেটেও যান।
১৩ বছর আগে মফিউজ্জামানের স্ত্রী জহুরা বেগম মারা যান। পরে লালমনিরহাট সদর উপজেলার বেলপাড়া গ্রামের ফজল উদ্দিনের মেয়ে ফরিদা বেগমের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়। প্রথম স্ত্রীর দুই ছেলে জহুরুল ও সিরাজুল শ্রমিকের কাজ করেন। তাঁরা সংসার থেকে পৃথক। মেয়ে জেলেকা খাতুনের বিয়ে হয়েছে। দ্বিতীয় স্ত্রীর একমাত্র ছেলে বরাদুল তৃতীয় ও মেয়ে স্বপ্না দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে শম্পার বয়স দুই বছর।
মুক্তিযোদ্ধা মফিউজ্জামান বলেন, ‘বর্তমানে মাসিক আট হাজার টাকা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছি। কিন্তু তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভাড়ায় রিকশাভ্যান চালাচ্ছি। বয়স অনেক হয়েছে। এখন কয়েক ঘণ্টা রিকশাভ্যান চালালে হাঁপিয়ে উঠি। এরপরও চালাতে হচ্ছে।’