বাংলাদেশে ২ কোটি মানুষ আর্সেনিক দূষণের শিকার

জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এইচআরডব্লিউয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষক রিচার্ড পিয়ার্সহাউস l প্রথম আলো
জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এইচআরডব্লিউয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষক রিচার্ড পিয়ার্সহাউস l প্রথম আলো

দেশের আর্সেনিক সমস্যা ২০ বছর আগে যে অবস্থায় ছিল, এখনো সেই অবস্থায় আছে। এখনো প্রায় ২ কোটি মানুষ আর্সেনিক দূষণের শিকার।
আর্সেনিক সমস্যা যতটা কারিগরি, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) গতকাল বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য দিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে ‘স্বজনপ্রীতি এবং অবহেলা: বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের খাবার পানিতে আর্সেনিক প্রতিরোধে ব্যর্থ প্রচেষ্টা’ শিরোনামের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
এইচআরডব্লিউর দাবি, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪৩ হাজার মানুষ আর্সেনিকজনিত রোগে মারা যাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে এইচআরডব্লিউর জ্যেষ্ঠ গবেষক রিচার্ড পিয়ার্সহাউস গবেষণা প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন ও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি বলেন, ২০০০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত নলকূপ যাচাই করে দেখা যায় যে দেশের ২০ শতাংশ নলকূপের পানিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক। প্রায় ২ কোটি মানুষ এই দূষিত পানি পান করে বা ব্যবহার করে। এত বছর পরও মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে না। এখনো প্রায় ২ কোটি মানুষ আর্সেনিক দূষণের শিকার। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশে আর্সেনিক সমস্যাটি চিহ্নিত হয়।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধিরা বলেন, নিরাপদ পানির অধিকার একটি মানবাধিকার। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা আর্সেনিক দূষণের মতো বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশের পাঁচটি গ্রামের তথ্য এবং কেন্দ্রীয়ভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য পর্যালোচনা করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর ডেভিড মেফাম উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিবেদনের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ওয়াটার এইড বাংলাদেশের প্রতিনিধি মো. খায়রুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আর্সেনিক দূষণ ও এর ভয়াবহতার বিষয়টি সরকার ও দাতারা ভুলে যেতে বসেছে। দূষণের শিকার মানুষের প্রতি চরম অবহেলা দেখানো হয়েছে। এইচআরডব্লিউর এই প্রতিবেদন বিষয়টির দিকে মনোযোগ আকর্ষণে সহায়তা করবে।
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, নিরাপদ পানির অন্যতম উৎস গভীর নলকূপ। এর মূল্য প্রায় ১ হাজার ডলার হওয়ায় দরিদ্র মানুষ তা বসাতে পারে না। সরকারের কাছ থেকেই মানুষ গভীর নলকূপ পায়। এ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানটি। তারা বলছে, রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা, বিশেষ করে সাংসদ ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা নিজেদের লোকদের এসব নলকূপ দেন। রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানের মধ্যে সাংসদদের ৫০ শতাংশ নলকূপ বরাদ্দে প্রভাব খাটানোর ব্যবস্থা আছে। তাই প্রয়োজনের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় রাজনীতি। তবে এটি বিশেষ কোনো দলের ক্ষেত্রে সত্য তা নয়, সব দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠানটি সরকারের নীতি পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে।
তবে এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন খায়রুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় গভীর নলকূপ বিতরণ হয়—এই বক্তব্য সঠিক ধরে নিলেও পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ওই অভিযোগ আর থাকে না। কারণ, দেখা গেছে গ্রামাঞ্চলে একটি গভীর নলকূপের পানি বহু পরিবার ব্যবহার করে।
প্রতিবেদনে ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সরকারের স্থাপন করা ১ লাখ ২৫ হাজার নলকূপের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, এর ৫ শতাংশ নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি। এটা হয়েছে সঠিক স্থান নির্বাচন না করার জন্য অথবা ঠিকভাবে স্থাপন না করার জন্য। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশের কোন কোন স্থানে আর্সেনিক বেশি তার মানচিত্র আছে। কিন্তু সেই মানচিত্রকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। ৯৯ শতাংশ ঝুঁকি এবং শূন্য ঝুঁকির স্থানকে সমান গুরুত্ব দিয়ে নলকূপ বিতরণ করা হচ্ছে। এটা সুশাসনের সমস্যা।
দূষিত হওয়া এসব নলকূপ প্রতিস্থাপন বা ঠিক করার কোনো উদ্যোগ সরকার নেয়নি। কিন্তু ইউনিসেফ নিয়েছে। ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ২০ হাজার ৫৯৭টি নলকূপ বসায় ইউনিসেফ। ২০১৩ সালে এসে দেখে, ১ হাজার ৭৩৩টি নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক। একে একে এই ১ হাজার ৭৩৩টি নলকূপ সংশোধন বা পুনঃস্থাপন করে ইউনিসেফ। এইচআরডব্লিউ তাদের সুপারিশে বলেছে, একই কাজ বিশ্বব্যাংকেরও করা উচিত। বিশ্বব্যাংকও এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দাতা সংস্থা।
এ ব্যাপারে গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্বব্যাংকের দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। একজন কোনো মন্তব্য করতে চাননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বব্যাংক ১৯৯৮ সাল থেকে এই বিষয়ে কাজ করছে ও সরকারকে সহায়তা দিচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে একটি প্রকল্প চালু আছে যার মাধ্যমে ১২ লাখ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে রিচার্ড পিয়ার্সহাউস বলেন, দেশের ৬৫ হাজার মানুষ আর্সেনিকজনিত রোগে ভুগছে এমন তথ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আর্সেনিক দূষণের শিকার মানুষের চিকিৎসায় রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের প্রশ্ন ওঠে না, কারণ কার্যত কোনো সেবা সরকারের পক্ষ থেকে নেই।
এই সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার দুই ঘণ্টা পর বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে সংবাদ ব্রিফিং করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আর্সেনিক দূষণের শিকার মানুষের সেবার বিষয়ে এইচআরডব্লিউর মন্তব্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রিফিংয়ে উপস্থিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দীন মো. নূরুল হক বলেন, এই প্রতিবেদন তৈরির ব্যাপারে তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যসচিব উপস্থিত ছিলেন।
কিন্তু এইচআরডব্লিউ প্রতিবেদন তৈরির সময় তথ্য চেয়ে যে চিঠি দিয়েছে, তার অনুলিপিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নাম রয়েছে।
বিবিসিকে সচিব: বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, আর্সেনিক সমস্যা থেকে সরকারের দৃষ্টি সরেনি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মালেক বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ১৯৯৩ সালে যখন এই ঝুঁকির বিষয়টি সামনে আসে, তখন বাংলাদেশের ২৬ শতাংশ মানুষ আর্সেনিকের ঝুঁকিতে আছে বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সচিব দাবি করেন, সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের কারণে এই ঝুঁকি এখন ১২ শতাংশে নেমে এসেছে।