দুই বছরে কর্মসংস্থান মাত্র ৬ লাখ

দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। কর্মসংস্থান না বাড়ার কারণেই বেকারত্ব বেড়েছে। বর্তমানে দেশে ২৬ লাখ ৩১ হাজার মানুষ বেকার। বেকারের এই সংখ্যা গত দেড় দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

বেকারের এ হিসাব সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)। বিবিএসের হিসাবে, গত দুই বছরে দেশে প্রতিবছর গড়ে মাত্র তিন লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। অর্থাৎ সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন সময়ে ব্যাপক কর্মসংস্থানের দাবি করলেও পরিসংখ্যান তা বলছে না। যেমন চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় প্রতিবছর গড়ে ১৩ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার কথা বলা আছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, নতুন কর্মসংস্থানের তথ্যটি আরও বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিত। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে এ কর্মসংস্থানের তথ্য মেলে না। গত দুই বছরে ছয় লাখ কর্মসংস্থান গ্রহণযোগ্য নয়।
বিবিএস সম্প্রতি শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৫  জুলাই-সেপ্টেম্বর রিপোর্টের কাজ শেষ করেছে। এতে গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বেকারত্ব পরিস্থিতি পাওয়া গেছে। এখন থেকে বিবিএস নিয়মিত ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে শ্রমশক্তি জরিপ প্রকাশ করবে।

>বেকারের সংখ্যা এখন দেড় দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, বেকারদের মধ্যে ৭৪ শতাংশই তরুণ-তরুণী

বিবিএসের এ জরিপে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পান না। ২০১৩ সালের জরিপে এ সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। দুই বছরের ব্যবধানে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪০ হাজার। শ্রমশক্তি জরিপ ২০০২ অনুযায়ী, তখন বেকার মানুষ ছিল ২০ লাখ। এরপর বেকার মানুষ কমানো যায়নি, বরং বেড়েছে। বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ।
বেকারত্বের এ হিসাব আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) দেওয়া মানদণ্ড অনুযায়ী করা হয়েছে। আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী, সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা কাজ না করলে বেকার হিসাব ধরা হয়। আর সপ্তাহে যাঁরা এক ঘণ্টা কাজ করেন, তাঁদের অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় বা কর্মরত হিসেবে ধরা হয়। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে কর্মরত এমন লোকের সংখ্যা ৫ কোটি ৮৭ লাখ। এর মধ্যে ৭২ লাখ ৮৭ হাজার জন গৃহস্থালির কাজে পরিবারকে সহায়তা করেন, মজুরি পান না। সপ্তাহে কেউ যদি এক ঘণ্টা গৃহস্থালির কাজকর্ম করেন, তাঁকেও আর বেকারের পর্যায়ে রাখা হয় না। ফলে দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি, প্রায় এক কোটি। এঁরা কোনো আয়ই করেন না।
অন্যদিকে কর্মরতদের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন ২ কোটি ২৮ লাখ ৩৯ হাজার মানুষ। আর নিজের প্রতিষ্ঠান বা কৃষিকাজে নিয়োজিত আছেন ২ কোটি ৬৬ লাখ ৫৬ হাজার মানুষ। এ ছাড়া নিজের প্রতিষ্ঠান বা কৃষিক্ষেত্রে কর্মী নিয়োগ করে কাজ করান ১৭ লাখ ২২ হাজার মানুষ। আর বিভিন্ন কাজকর্মে নিয়োজিত আছেন আরও ২ লাখ ১৯ হাজার।
শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বেকারদের মধ্যে প্রায় ৭৪ শতাংশই তরুণ-তরুণী। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ১৯ লাখ ৩৯ হাজার তরুণ-তরুণী কোনো কাজ করেন না। তাঁরা সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজও করার সুযোগ পান না, অথচ তাঁরা সব সময়ই কাজের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত থাকেন। বিবিএসের জরিপ বলছে, উচ্চশিক্ষা শেষ করেও প্রায় ৭৮ হাজার তরুণ-তরুণী কাজ কিংবা চাকরি পাচ্ছেন না। তরুণ প্রজন্মের বেকারদের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা আছেন ৬ লাখ ৪৪ হাজার। আর মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন বেকারের সংখ্যা যথাক্রমে ৭ লাখ ৭৬ হাজার এবং ২ লাখ ৯২ হাজার। শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই এমন বেকার ১ লাখ ৪৬ হাজার।
আগের চেয়ে পুরুষ বেকার বাড়লেও নারীদের মধ্যে কমেছে। এখন দেশে সাড়ে ১৩ লাখ পুরুষ কোনো কাজ করেন না। আর নারীদের মধ্যে এ সংখ্যা ১২ লাখ ৮০ হাজার।
কর্মসংস্থান: শ্রমশক্তি জরিপে কর্মসংস্থানেরও বিরূপ চিত্র উঠে এসেছে। ২০১৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, তখন কর্মরত মানুষের সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৮১ লাখ। ২০১৫ সালের জরিপে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৮৭ লাখ। এর মানে হলো, ওই দুই বছরে দেশে মাত্র ৬ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
বিবিএসের পুরোনো তথ্য নিয়ে এর আগের কয়েক বছরের কর্মসংস্থানের তুলনা করলে দেখা যায়, ২০১১ থেকে ২০১৩ সময়ে প্রতিবছর গড়ে ১৩ লাখের বেশি লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০১১ সালের শ্রমশক্তি জরিপে কর্মরত লোকের সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৪১ লাখ। এর আগে পাঁচ বছরেও প্রতিবছর গড়ে ১৩ লাখের মতো কর্মসংস্থান হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের এ হিসাবটি মেলে না। যত প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তাতে আরও বেশি কর্মসংস্থান হওয়ার কথা। কিন্তু মূল সমস্যা হলো, শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের জন্য আমরা মানসম্পন্ন ভালো আয়ের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছি না। এতে উৎপাদনশীলতা কম হচ্ছে।’
জাহিদ হোসেন মনে করেন, ‘এ দেশে অনানুষ্ঠানিক খাতে সিংহভাগ কর্মসংস্থান হয়। শিল্প ও সেবার মতো সুগঠিত খাতে যত দিন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে না পারব, তত দিন এভাবেই ঠুকতে ঠুকতে চলবে।’
বর্তমানে শ্রমশক্তিতে ৬ কোটি ১৪ লাখ নারী-পুরুষ আছেন। এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৩১ লাখ এবং নারী ১ কোটি ৮৩ লাখ। দেশের কৃষি খাত এখনো কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। এ খাতে ২ কোটি ৫৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে, যা মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৩ শতাংশ। এরপরের স্থানে থাকা সেবা খাতে কাজ করেন ২ কোটি ১৪ লাখ। আর শিল্প খাতে ১ কোটি ১৪ লাখ লোক কাজ করেন।
এ বিষয়ে বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ প্রথম আলোকে বলেন, মাঠ পর্যায়ের তথ্যের ভিত্তিতে এ সমীক্ষাটি করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং অতিক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানসহ নিচের দিকে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশি কর্মসংস্থান হচ্ছে।