শুভ জন্মদিন মোজাফফর আহমদ

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ

একাত্তরে যে রাজনীতিক উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে যৌথভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন, তিনি মোজাফফর আহমদ। সাধারণের কাছে যিনি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ নামে পরিচিতি। আজ ১৪ এপ্রিল, তাঁর ৯৫তম জন্মদিন। ১৯২২ সালের এই দিনে কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
চল্লিশের দশকে ‘পাকিস্তান উন্মাদনার’ বিপরীতে যে মুষ্টিমেয় মুসলমান তরুণ ছাত্রাবস্থায় বামপন্থায় দীক্ষা নিয়েছিলেন, মোজাফফর আহমদ তাঁদের একজন। নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সন্দ্বীপের সন্তান কমরেড মোজাফফর আহমদকে। ১৯৫১-৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন হয়, তখন মোজাফফর আহমদ ঢাকা কলেজের শিক্ষক। তাঁর আজমপুরের ৮/আই কলোনির বাসায়ই কমিউনিস্ট নেতারা নিয়মিত বৈঠক করতেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন নেপাল নাগ, খোকা রায়, অনিল মুখার্জি, সত্যেন সেন। তিনি নিজেও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
এরপর মোজাফফর আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেও সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ৬২ বছর ধরেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে আছেন। তাঁর সহযাত্রীদের অনেকে প্রয়াত, অনেকে ভিন্ন দলে। কিন্তু তিনি রয়ে গেছেন নিঃসঙ্গ শিরোপা। নিজেকে পরিচয় দেন কুঁড়েঘরের মোজাফফর হিসেবে।
পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে মোজাফফর আহমদ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখেন। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হলে তিনি এর কেন্দ্রীয় নেতা হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে মোজাফফর আহমদের নামে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এর আগেই তিনি নিষিদ্ধঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। ১৯৬৭ সালে ন্যাপ বিভক্ত হলে মস্কোপন্থী অংশের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতির দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে।
মুক্তিযুদ্ধকালে মোজাফফর আহমদ মুজিবনগর সরকারে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে নিউইয়র্ক যান। সেখানে অবস্থানকালে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অবস্থানরত প্রবাসীদের মুখপত্র পাকিস্তান ফোরাম-এর সম্পাদক ফিরোজ আহমদকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোজাফফর আহমদ বলেছিলেন, মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ হতে পারে প্রস্তাবিত যুক্তফ্রন্টের প্রথম ধাপ। তিনি চেয়েছিলেন, আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকলেও মুজিবনগর সরকার উপদেষ্টা পরিষদের দিকনির্দেশনামতো চলুক। এতে মুক্তিযুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা শাণিত হবে। তিনি আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে নিলেও মনে করতেন, আওয়ামী লীগ যেখানে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম শেষ করবে, সেখান থেকেই বামপন্থীদের যাত্রা শুরু হবে।
আওয়ামী লীগের একাংশ কখনো চায়নি বামপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিক। অনেক সময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদও অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। এ অবস্থায় ন্যাপ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে (সিপিআই) দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের ভূমিকা নিশ্চিত করে। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় পৃথক গেরিলা বাহিনী। মোজাফফর আহমদের সম্পাদনায় নতুন বাংলা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাও প্রকাশিত হয় মুজিবনগর থেকে।
স্বাধীনতার পর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদই প্রথম জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তা মেনে নেয়নি। পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতিতেও মোজাফফর আহমদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭৯ সালের সংসদে নির্বাচিত হয়ে তিনি সমাজতন্ত্রের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। মনে আছে, একবার বিতর্কে অংশ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ভয়েস অব আমেরিকা না শুনে ভয়েস অব মস্কো শুনুন।’
আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী এই প্রবীণ রাজনীতিক ১৯৮১ সালে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও একতা পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
কয়েক বছর ধরে মোজাফফর আহমদ শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলেও দেশ নিয়ে এখনো ভাবেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়েন। কখনো নিজে পড়তে না পারলে কেউ পড়ে শোনান। সারা জীবন যে গরিব মানুষের রাজনীতি করেছেন, তাদের অবস্থা জানতে চান। তিনি মনে করেন, পুরোনো সোভিয়েত ব্যবস্থায় না হলেও নতুন ধারায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এর বিকল্প নেই।
কিন্তু কারা করবেন?
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদও বিশ্বাস করেন, নতুন প্রজন্মই সমাজ বদলের সংগ্রামের অগ্র সেনানী হবে।
গত বছর আওয়ামী লীগ সরকার মোজাফফর আহমদকে স্বাধীনতা পদক দেওয়ার ঘোষণা দিলে তিনি সবিনয়ে সেটি নিতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেছিলেন, তিনি কোনো পুরস্কারের জন্য রাজনীতি করেননি। মানুষের ভালোবাসাই তাঁর পুরস্কার।
জন্মদিনে তাঁকে জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।