সহিংসতায় উদ্বেগ, তবু পুরোনো ছকেই সরকার

মুখে সংলাপ-সমঝোতার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পুরোনো ছকে এগোচ্ছে সরকার। তবে বিরোধী দলের টানা অবরোধ কর্মসূচিতে গত দুই দিন দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতায় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

পরিস্থিতি সামাল দিয়ে শেষ পর্যন্ত একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের অনেকে চিন্তায় পড়েছেন বলেও একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বর্তমান মন্ত্রিসভার একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, আগামী এক সপ্তাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কী হবে, এই মুহূর্তে স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের টানা অবরোধে সড়ক ও রেলযোগাযোগ ভেঙে পড়ায় কার্যত দেশ অচল হয়ে পড়েছে। আজ সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি বাড়ানো হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে গত মঙ্গলবার রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও মন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে ভূমি ও ত্রাণমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, শিল্প ও পূর্তমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচিতে দেশব্যাপী সহিংসতা মোকাবিলার বিষয়ে আলোচনা হয়। কিছু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও পদস্থ কর্মকর্তাদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।

সাবির্ক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকেও নেতাদের মধ্যে আলোচনা হয়। বিশেষ করে রেলপথে সহিংসতা এবং দুই দিনে বিজিবির সদস্যসহ ১৬ জনের প্রাণহানি নিয়েও কথাবার্তা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক কঠোর পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ করেন নেতারা।

এ বিষয়ে গতকাল সরকারের বর্তমান ও সদ্য বাদ পড়া কয়েকজন মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা জানান, এত দিন ধরে বিরোধী দলের রাজপথের আন্দোলন সরকারকে খুব একটা চাপে ফেলতে পারেনি। কর্মসূচিগুলোতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণও ছিল নগণ্য। ফলে সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ধারণা ছিল, আন্দোলন করে বিএনপি নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না। তাই বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ-সমঝোতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কেবল মুখরক্ষার জন্যই দলের নেতারা সংলাপ বা আলোচনার কথা বলে আসছেন। কিন্তু গত দুই দিনে বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচিতে দেশব্যাপী অচলাবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। কিছু কিছু এলাকায় প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ কমে গেছে। এতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি ভালো মনে হচ্ছে না। আর সদ্য বাদ পড়া একজন মন্ত্রী বলেন, সারা দেশে সহিংসতা, জনমনে আতঙ্ক—সব মিলিয়ে বিষয়টা ভালো ঠেকছে না।

তবে গত দুই দিনের ঘটনায় সরকার উদ্বিঘ্ন হলেও একতরফা নির্বাচনের চিন্তা থেকে সরে আসেনি। বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আগের ছক অনুযায়ী এগোচ্ছে বলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একধিক সূত্র জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে নির্বাচন নিয়ে তাঁর কঠোর অবস্থানের কথাই পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বিরোধীদলীয় নেতাকে এক-এগারোর ঘটনা এবং সংবিধানের ৫৭(৩) অনুচ্ছেদের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।

প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হস্তান্তরসংক্রান্ত সংবিধানের এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না।’

অবশ্য শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে বিএনপির চূড়ান্ত রাজনৈতিক অবস্থানের বিষয়টিও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা অবগত আছেন। তার পরও আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা জানান, নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানের পদে শেখ হাসিনাই থাকবেন, এটাই আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত অবস্থান। বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা বা সংলাপ যা-ই হোক, আওয়ামী লীগ এই রাজনৈতিক অবস্থান থেকে নড়বে না। শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই আওয়ামী লীগের নেতারা অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি আছেন।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দাবি করেন, আওয়ামী লীগ সব দলকে নিয়েই নির্বাচনে যেতে চায়। সমাধান হবে না, তা এখনো বলা যাচ্ছে না।