কাজী জাফরনামা

এরশাদ ও কাজী জাফরের বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কারের ঘটনা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনীতির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক আলোচনা চলছে। কিন্তু জাতীয় পার্টি থেকে কাজী জাফরের বহিষ্কার এবারই প্রথম নয়। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে নতুন দল জাতীয় পার্টি (জা-মো) গঠন করেন তিনি। তখনো দল থেকে বহিষ্কৃত হন কাজী জাফর। এর বছর খানেক পর আবারও দলে ফেরেন তিনি। এর বাইরেও রাজনৈতিক জীবনে নানা ডিগবাজি, দল পরিবর্তন আর দুর্নীতির নানা অভিযোগে ব্যাপকভাবে আলোচিত কাজী জাফর।

নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেওয়া নিয়ে মতবিরোধের জেরে আজ বৃহস্পতিবার কাজী জাফরকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। এর কিছুক্ষণ পরই সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে এরশাদকেই পাল্টা বহিষ্কারের ঘোষণা দেন কাজী জাফর।

নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেওয়া বিষয়ে এরশাদকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবেও মন্তব্য করেন কাজী জাফর। এরশাদ শুরুতে কাজী জাফরকে ‘ফ্যামিলি মেম্বার’ বললেও বহিষ্কারের আগে সাংবাদিকদের কাছে আক্ষেপ করে বলেন, ‘উনি (কাজী জাফর) যখন অসুস্থ ছিলেন, তখন ৩০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে ওনার চিকিত্সা করিয়েছি। তিনি বলেছেন, “আপনি আমায় জীবন দিয়েছেন। চিরকাল আপনার সঙ্গে থাকব।” উনি এখন প্রতিদিন আমার বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিবৃতি দিচ্ছেন। তিনি আজ থেকে আর আমার দলে নেই।’

গত সোমবার বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এরশাদ বলেছিলেন, ‘হোয়াট হি সেইস, ডাজ নট ম্যাটার। হোয়াট আই সে, ম্যাটারস। হু ইজ কাজী জাফর? আই এম দি ফাদার অফ জাতীয় পার্টি?’

পরে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে এরশাদকে উদ্দেশ করে কাজী জাফর বলেছেন, ‘আমি শুনেছি তিনি (এরশাদ) বলেছেন, “হু ইজ কাজী জাফর? আই এম দি ফাদার অফ জাতীয় পার্টি।” আমি তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই, হু ইজ এরশাদ? এরশাদ সবকিছুর পিতৃত্ব দাবি করতে পারেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির পিতৃত্ব তিনি দাবি করতে পারেন না।’

কাজী জাফরের রাজনৈতিক জীবন অনুসন্ধান করতে গিয়ে বের হয়ে আসে নানান তথ্য। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একাধিক নেতা প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, এক সময়ের ঝানু শ্রমিকনেতা কাজী জাফর কতটা ডিগবাজি খেতে পারেন, সেটা তাঁর রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ৫৮ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কাজী জাফর অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ষাটের দশকের শুরুতে। পরবর্তী সময় যুক্ত হন শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে।

১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। টঙ্গী অঞ্চলের একজন প্রভাবশালী শ্রমিকনেতা হিসেবে বিভিন্ন আন্দোলনে শ্রমিকদের সংগঠিত করার ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল।

মাওপন্থী নেতা কাজী জাফর এক সময় সঙ্গী হন জিয়াউর রহমানের। সামরিক শাসককে রাজনৈতিক বৈধতা দেওয়ার খাতিরে তল্পিবাহক রাজনৈতিক দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি বানান তিনি। পরে জিয়াউর রহমান ইউনাইটেড ফ্রন্ট গঠন করলে ছিটকে পড়েন কাজী জাফর।

১৯৮৫ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেওয়ার আগে সাত দলভুক্ত ইউপিপির  চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় কাজী জাফর এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘স্বৈরাচারী এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাব না।’ টেনেহিঁচড়ে এরশাদকে ক্ষমতা থেকে নামানোরও হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। এর আগে সুনামগঞ্জ বিএনপির নেতা ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে ‘এরশাদের গোয়ালে আরেকটি রাম ছাগল যোগ দিয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন কাজী জাফর। ওই বক্তব্যের পরদিনই সেই ‘গোয়ালে’ই যোগ দেন কাজী জাফর।

রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, এরশাদের মন পাওয়ার মন্ত্র কাজী জাফরের জানাই ছিল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের পর একসময় এরশাদ তাঁকে বানালেন প্রধানমন্ত্রী। ১২ আগস্ট ১৯৮৯ থেকে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৮৮ সালে বন্যার্ত মানুষের জন্য বিদেশ থেকে আসা কোটি কোটি টাকার চিনি বাজারে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ উঠে তাঁর বিরুদ্ধে। চিনির কৃত্রিম সংকট তৈরির পর দাম বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় একটি সিন্ডিকেট। ক্ষুব্ধ মানুষজন তখন দোকানে গিয়ে বলতেন, ‘এক পোয়া জাফর হবে’। সেই থেকে কাজী জাফর পরিচিতি পেয়ে যান ‘চিনি জাফর’ হিসেবে। মন্ত্রী থাকার সময়ে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের দায়ে ১৯৯৯ সালে ১৫ বছরের সাজাও হয়েছিল তাঁর।

তার পরও দলের রাজনীতিতে কাজী জাফরের প্রভাব কমেনি। জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে যাচ্ছিলেন কাজী জাফর। মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টিকে সরিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে একত্র করার দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। কিন্তু এরশাদের হস্তক্ষেপে সেটাও ব্যর্থ হয়ে গেল।

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর কারাবন্দী থাকা অবস্থায় জামিন নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন কাজী জাফর। পরবর্তী সময় সেখানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পাওয়ায় সে দেশের গণমাধ্যমের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল অস্ট্রেলীয় সরকার। শরণার্থী হয়ে পাক্ষিক ৩৭০ ডলার ভাতাও পেতেন তিনি। সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কাজী জাফর আহমদ কীভাবে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিলেন, সে রহস্য খুঁজে দেখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে কাজী জাফরের অবস্থা কী দাঁড়ায়, সেটার অপেক্ষায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।