এই রায় সংবিধান পরিপন্থী, আপিলে টিকবে না

.
.

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় নিয়ে গতকাল উত্তপ্ত হয়ে ওঠে জাতীয় সংসদের অধিবেশন। পয়েন্ট অব অর্ডারে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সাংসদেরা হাইকোর্টের রায়ের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁরা ৩০০ বিধিতে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য দাবি করেন। আইনমন্ত্রী বলেন, হাইকোর্টের এই রায়ই সংবিধান পরিপন্থী। আপিল বিভাগে এটা টিকবে না।
প্রধান বিচারপতিসহ উচ্চ আদালতের বিচারকদের কড়া সমালোচনা করে বক্তব্য দেন সাংসদেরা। এ সময় কয়েক দফায় সংসদে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে হিমশিম খেতে হয়। বিচারপতিদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর বিল উত্থাপন করা হলে এর প্রতিবাদে বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির সাংসদেরা ওয়াকআউট করেন।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে দিনের কার্যসূচি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পয়েন্ট অব অর্ডারে জাতীয় পার্টির সাংসদ ফখরুল ইমাম হাইকোর্টের রায় নিয়ে বক্তব্য দেন। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও আওয়ামী লীগের সাংসদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমও পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পান। উভয় নেতা বিচারপতিদের তীব্র সমালোচনা করেন। আইনমন্ত্রীর বক্তব্যও ছিল ধারালো। ওয়াকআউট এবং পয়েন্ট অব অর্ডারে আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধিবেশনকক্ষে উপস্থিত ছিলেন না।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্য: ৩০০ বিধিতে দেওয়া বক্তব্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। এখনো বিশ্বাস করি, বিচার বিভাগ স্বাধীন। সে কারণে এই রায়ের বিরুদ্ধে আগামী রবি-সোমবারের মধ্যে আপিল করব। আইনি পথেই যাব, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র সহ্য করব না।’
হাইকোর্টের রায়ের প্রসঙ্গ টেনে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে সংবিধানের এই সংশোধনী এনেছি। কিন্তু ওনারা (হাইকোর্টের বিচারকেরা) রায়ে বলে দিলেন, এটা অবৈধ। এখনো আমি বলি, এটা মোটেও অবৈধ নয়। ওনারা যেটা বলছেন, সেটাই বরং গ্রহণযোগ্য নয়।’
আইনমন্ত্রী বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বিচারপতিদের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার জন্যই সরকার ষোড়শ সংশোধনী এনেছে। তিনি বলেন, মূল সংবিধানের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা চলে না।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের একপর্যায়ে জাতীয় পার্টির সদস্যরা তুমুল হইচই শুরু করলে তিনি কিছুটা দৃঢ় কণ্ঠেই বলেন, ‘দিস ইজ নট দ্য লাস্ট ডিসিশন (এটা শেষ সিদ্ধান্ত নয়)...আপিল করলে এ সিদ্ধান্ত থাকবে না।’
পয়েন্ট অব অর্ডারে আলোচনা: বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এ সংসদ সার্বভৌম। আমরাই বিচারপতিদের নিয়োগ দিয়েছি। হাইকোর্ট সংসদ-প্রণীত আইন বাতিল করলে এটা খারাপ দৃষ্টান্ত হবে। এটা হতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘সামরিক শাসনামলে সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন ও বিচারপতি মাহমুদ হোসেনকে অসম্মানজনকভাবে বিদায় করা হয়েছিল। এখন সে সুযোগ নেই। এখন কাউকে অপসারণ করতে হলে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে। হাইকোর্টের এ রায়ে আমরা দুঃখিত, ব্যথিত ও মর্মাহত।’
তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘যাঁরা বিচারক, তাঁদের আমরা চিনি, জানি। আমরা ক্ষমতায় বলেই তাঁরা বিচারক হয়েছেন। তাঁরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করবেন, তা আমরা প্রত্যাশা করি।’ তিনি বলেন, ‘একজন বিচারপতি আরেকজন প্রধান বিচারপতির বিরোধিতা করছেন। এটার অবসান হওয়া উচিত।’
শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘এ রায়ের পেছনে ষড়যন্ত্র আছে। রাষ্ট্রপতি অপরাধ করলে সংসদ তাঁকে অপসারণ করতে পারলে বিচারপতিরা কোথা থেকে এসেছেন যে তাঁদেরটা করা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘বিচারপতিদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর আইন যদি আমরা পাস না করি, তাহলে তাঁরা কি এ আইন পাস করতে পারবেন?’
এর আগে পয়েন্ট অব অর্ডারের সূত্রপাত করে জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বলেন, ‘সংসদে যে আইন পাস করা হয়, তা যদি একটার পর একটা অবৈধ হয়ে যায়, তাহলে তো আইনসভার কোনো মর্যাদা থাকে না। এভাবে সংসদে পাস করা আইন বিচার বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করলে সাংসদেরা ছিনিমিনি খেলার বস্তুতে পরিণত হবেন। এ রকম চলতে থাকলে সংসদে যে আইন পাস হবে, তা-ই অবৈধ হয়ে যাবে।’
একই দলের কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘এই সংসদে পাস করা আইন যদি অবৈধ হয়ে যায়, তাহলে তারা (বিচারকেরা) আইন করুক। আমাদের দিয়ে পাস করিয়ে নিক।’
জাসদের মঈন উদ্দীন খান বাদল বলেন, ‘বিচার বিভাগকে যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাঁরা ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছেন কি না, জানি না। মূল সংবিধানে যেটা ছিল, সংসদ সেটাই পুনস্থাপন করেছে। তাহলে এটাকে বিচার বিভাগ কী করে অবৈধ বলে দেন?’ তিনি বলেন, ‘এ রায় দেওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে সংঘাত সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন, যেটা একান্তই অনভিপ্রেত।’
জাপার ওয়াকআউট: উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করতে সুপ্রিম কোর্ট জাজেস (রেমুনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজেস) (সংশোধন) বিল ২০১৬ সংসদে উত্থাপিত হয়। বিলটি পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য আইন, বিচার ও সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া গতকাল মন্ত্রী-সাংসদদের বেতন-ভাতা বাড়াতে বিল পাস হয়েছে।
স্পিকার আইনমন্ত্রীকে বিচারপতিদের বেতন-ভাতার বিল উত্থাপনের অনুরোধ জানালে জাতীয় পার্টির সদস্যরা উচ্চকণ্ঠে এর বিরোধিতা করেন। এ সময় আইনমন্ত্রী জাতীয় পার্টির সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘বিচারপতিরা অবিবেচক হতে পারেন। সংসদ অবিবেচক নয়। তাঁরা যে রায় দিন না কেন, আমরা হীনম্মন্যতার শিকার হব না। আমরা উদারতা দেখাব।’
এরপর আনিসুল হক বিলটি উত্থাপনের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলে জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেন, বিচারপতিরা যদি জাতীয় সংসদের আইন বাতিল করতে পারেন, তাহলে তো তাঁরা নিজেরাই নিজেদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নিতে পারেন। এই রায় বাতিল না হওয়া পর্যন্ত বিলটা স্থগিত করে সংসদের প্রতি সম্মান দেখানো হোক।
এরপর আইনমন্ত্রী বিল উত্থাপন করলে জাতীয় পার্টির সদস্যরা প্রতিবাদে ওয়াকআউট করেন। বিল উত্থাপন শেষে তাঁরা অধিবেশনে ফিরে আসেন।