নিজামীর ফাঁসি কার্যকর

.
.

একাত্তরের ভয়ংকর খুনে বাহিনী আলবদরের নেতা ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি কার্যকর হয় বলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এটি ফাঁসি কার্যকরের পঞ্চম ঘটনা।
এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
কারাগার সূত্র বলেছে, সন্ধ্যার পর ফাঁসি কার্যকরের নির্বাহী আদেশ পৌঁছায় কারাগারে। রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ঢাকার সিভিল সার্জন মালেক মৃধা প্রধান ফটক দিয়ে কারাগারে ঢোকেন। ১০টার পর ঢোকেন ভারপ্রাপ্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মো. ইকবাল হাসান। এর পরপরই ঢোকেন ঢাকার জেলা প্রশাসক সালাহউদ্দিন, ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রতিনিধি ডিবির উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম, লালবাগের উপকমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ। তাঁরা ঢোকার পর নিজামীকে গোসল করানো হয়। এরপর নিজামী নামাজ আদায় করেন। পরে কারাগারের মসজিদের ইমাম তাঁকে তওবা পড়াতে গেলে তিনি নিজেই তওবা পড়েন। এ সময় ফাঁসির মঞ্চের চারপাশে অবস্থান নেন ১০ জন সশস্ত্র কারারক্ষী। ১২টার আগে রাজুর নেতৃত্বে চার-পাঁচজন জল্লাদ নিজামীকে যমটুপি পরিয়ে হাত ধরে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যান। মঞ্চে তোলার পর তাঁর গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো হয়। জেলা প্রশাসক ও ম্যাজিস্ট্রেটের সংকেত পেয়ে জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর কবির তাঁর হাতে থাকা রুমাল মাটিতে ফেলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে জল্লাদ রাজু ও তাঁর সহযোগীরা লিভার টেনে ফাঁসি কার্যকরে সহযোগিতা করেন। সিভিল সার্জন মালেক মৃধা ১২টা ১০ মিনিটে নিজামীর মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
রাত ১২টা ৩৩ মিনিটে দুটি অ্যাম্বুলেন্স লাশ নিতে কারাগারে ঢোকে। দেড়টায় অ্যাম্বুলেন্স দুটি কারাগার থেকে বের হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাহারায় লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স রওনা দেয় পাবনার সাঁথিয়ার উদ্দেশে।
গতকাল সকালেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ঘিরে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। বেলা তিনটার পর কাশিমপুর কারাগার থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয় জল্লাদ রাজুকে। রাত আটটার দিকে কারাগারে ঢোকার মুখগুলোতে পুলিশ ব্যারিকেড বসায়। নাজিমউদ্দিন রোডের বাসিন্দা, সাংবাদিক, পুলিশ, র্যাব, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্য এবং দু-একটি সংগঠনের অল্প কিছু সদস্য ছাড়া আর কাউকে ওই এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। গলির ভেতরে উৎসুক জনতা জটলা করে। আটটার পর থেকে একে একে কারাগারের চারপাশের সব দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সড়কের দুই ধারের বাতিগুলো ছাড়া আশপাশের ভবনগুলোর বাতিও নিভিয়ে দেওয়া হয়।
পরিবারের ২৩ সদস্য রাত ৭টা ৫৫ মিনিটে তিনটি গাড়িতে করে নিজামীর সঙ্গে শেষ দেখা করতে কারাগারে যান। তাঁরা ৯টা ৩৩ মিনিটে বেরিয়ে আসেন।
এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে চারজনের ফাঁসি কার্যকরের সময় কারাগারের মূল ফটকের কাছে সাংবাদিকদের যেতে দিলেও গতকাল মূল ফটকের বাইরে তিন সারিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান নেয়। সাংবাদিকেরা এবং কয়েকটি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কিছুটা দূরে অবস্থান নেন। সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের হাতে ছিল নিজামীর কুশপুত্তলিকা ও প্রতীকী ফাঁসির দড়ি। কেউ কেউ স্লোগানও দেন।
সকালে ও দুপুরে ফাঁসির প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠক করে কারা কর্তৃপক্ষ। এতে ভারপ্রাপ্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মো. ইকবাল হাসান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর কবির, জেলার নেসার আলমসহ বেশ কয়েকজন কারা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। সকালে কারাগারের ভেতরে ঢুকে ফাঁসির মঞ্চসহ আশপাশের স্থান পরিদর্শন করেন তাঁরা। দুপুর ১২টার পর কারা অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কারা মহাপরিদর্শক ইকবাল হাসানের নেতৃত্বে আরেকটি বৈঠক হয়। এতে কারা অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-প্রিজন) গোলাম হায়দার, জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর কবির অংশ নেন।
রাত নয়টার দিকে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ অবস্থান নেয়। ফাঁসি কার্যকরের খবরে মঞ্চের সংগঠক-কর্মীরা উল্লাস প্রকাশ করেন।
আপিল বিভাগ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে নিজামীকে বলা হয়েছে একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নকশাকার। ২০০০ সালে সেই নিজামীই হন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের প্রধান বা আমির। এমনকি বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (২০০১-০৬) তিনি প্রথমে কৃষি ও পরে শিল্পমন্ত্রী হন। গাড়িতে উড়ত জাতীয় পতাকা। এ নিয়ে ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, নিজামীকে এ দেশের মন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রমহারা ২ লাখ নারীর গালে চড় মারা হয়েছে। এটা জাতির জন্য লজ্জা, অবমাননা। চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ও নিজামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে। ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা জজ আদালত এই রায় দেন। মামলাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন।
গ্রেপ্তার ও মামলা: ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে এক মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন নিজামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছরের ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল নিজামীর বিরুদ্ধে মামলায় ফাঁসির রায় দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন নিজামী। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি আপিল বিভাগেও নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল থাকে। এরপর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন নিজামী। ৫ মে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ নিজামীর আবেদন খারিজ করে দেন। প্রধান বিচারপতি মাত্র এক শব্দের আদেশে বলেন, ‘ডিসমিসড।’ এরপর থেকেই ফাঁসি কার্যকরের ক্ষণগণনা শুরু হয়। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের সুযোগ থাকলেও তিনি আবেদন করেননি।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত অভিযোগের ৪টিতে তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। এগুলো হলো বাউসগাড়ি ও ডেমরা গ্রামে ৪৫০ জনকে নির্বিচার হত্যা ও ধর্ষণ, করমজা গ্রামে ১০ জনকে হত্যা ও ৩ জনকে ধর্ষণ, ধুলাউড়ি গ্রামে ৫২ জনকে হত্যা এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা (২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ)। পরে আপিল বিভাগের রায়ে করমজা গ্রামে ১০ জনকে হত্যা ও ৩ জনকে ধর্ষণের দায় (৪ নম্বর অভিযোগ) থেকে নিজামীকে খালাস দেওয়া হয়েছে। বাকি তিন অভিযোগে তাঁর ফাঁসি বহাল রাখা হয়। এ ছাড়া একাত্তরে কছিমুদ্দিনসহ তিনজনকে হত্যা, মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে নির্যাতন ও হত্যা, সোহরাব আলীকে হত্যা এবং মুক্তিযোদ্ধা বদি, রুমি, আজাদ, সুরকার আলতাফ মাহমুদকে হত্যার দায়ে (১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগ) নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে কছিমুদ্দিনসহ তিনজনকে হত্যা এবং শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে নির্যাতন ও হত্যার দায় (১ ও ৪ নম্বর অভিযোগ) থেকে নিজামীকে খালাস দেন আপিল বিভাগ।
নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার রায়ে আপিল বিভাগ ও ট্রাইব্যুনাল পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, আলবদর বাহিনী যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, তার ওপর নিজামীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল। একাত্তরের মে মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি নিধনযজ্ঞে যোগ দেয় জমিয়তে তলাবা (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ)। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করার জন্য আলবদর ও আলশামস দুটি আধা সামরিক জঙ্গি বাহিনী গঠন করে ছাত্র সংঘ। এর মধ্যে আলবদরে যোগ দেয় জমিয়তে তলাবার বিপুলসংখ্যক সদস্য। এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিখিল পাকিস্তান ছাত্র সংঘ বা জমিয়তে তালাবার প্রধান (নাজিম-এ-আলা) মতিউর রহমান নিজামী। একাত্তরের ১৪ নভেম্বর জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এ নিজামী ‘বদর দিবস: পাকিস্তান ও আলবদর’ শীর্ষক প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানোর জন্য আলবদরদের উৎসাহ দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন