জিপিএ-৫ পেয়েছে কিশোর বাবুল

বাবুল শিকদার
বাবুল শিকদার

এসএসসি পরীক্ষায় মিরপুর আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের বাণিজ্য শাখা থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে বাবুল শিকদার। কিন্তু শিক্ষা–জীবনের এই অর্জন আর কখনোই জানা হবে না তার। কারণ, গতকাল বুধবার ফল প্রকাশের আগেই সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বন্ধুর স্টাম্পের আঘাতে নিভে গেছে তার জীবনপ্রদীপ।
পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে হৃদয় নামে পরিচিত বাবুল শিকদার। বন্ধুদের কাছে সে ছিল অত্যন্ত প্রিয়। পাড়া-প্রতিবেশী তাকে জানত অত্যন্ত ভদ্র ও মেধাবী বলে। মা-বাবার ছিল অতি আদরের। হৃদয়ের মৃত্যুতে তাই পুরো পাড়াতেই (মিরপুরের জনতা হাউজিং) নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
গতকাল সন্ধ্যায় জনতা হাউজিংয়ের গাউছিয়া জামে মসজিদে হৃদয়ের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষ হওয়ার পরপরই হৃদয়ের বন্ধুরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। হৃদয়দের ভাড়া বাসার সামনে ছিল এলাকাবাসীর জটলা। তার মা তাজেরা বেগমের আর্তনাদ সেখানে উপস্থিত অনেকেরই চোখ ভিজিয়ে দেয়।
মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ভূঁইয়া মাহবুব হাসান প্রথম আলোকে বলেন, জনতা হাউজিংয়ের ধানখেত মোড় এলাকার একটি ফাঁকা মাঠে সকাল ১০টার দিকে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল। উইকেটকিপিং করছিল হৃদয়। বিপক্ষ দলের হয়ে ব্যাট করছিল বিধান নামের আরেকটি ছেলে। খেলার একপর্যায়ে বিধান আউট হলে ম্যাচের আম্পায়ার ‘নো বল’ ঘোষণা দেন। পরের বলে বিধান আবারও আউট হলে বাবুল বলে ওঠে, ‘এটিও তাহলে নো বল।’ এ সময় ক্ষিপ্ত হয়ে বিধান স্টাম্প তুলে বাবুলকে আঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় বাবুলকে প্রথমে মিরপুর শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনে নেওয়া হয়। সেখান থেকে নেওয়া হয় গ্যালাক্সি হাসপাতালে। পরে আগারগাঁওয়ের নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হৃদয়ের বাবা মোস্তফা শিকদার যানবাহন মেরামতের গ্যারেজের মালিক। তাঁদের বাড়ি ফরিদপুরের দক্ষিণ আলমনগরে। দুই ভাইয়ের মধ্যে হৃদয় ছিল বড়। তাকে গ্রামের বাড়িতেই দাফন করা হবে।

ছেলে বাবুল শিকদারের মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়া মাকে (বাঁয়ে) সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা স্বজনদের l প্রথম আলো
ছেলে বাবুল শিকদারের মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়া মাকে (বাঁয়ে) সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা স্বজনদের l প্রথম আলো

মোস্তফা শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘হৃদয় বলত, বাবা, আমি বিদেশে পড়তে যাব। তুমি আমাকে যেতে দেবে? জিপিএ-৫ ঠিকই পেল। কিন্তু আমার সব চলে গেল। আমার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল...হৃদয় চলে গেল।’
হৃদয়দের ভাড়া বাসার মালিক খোরশেদ আলম রাকিব ভূঁইয়া বলেন, ‘তিন বছর হলো তারা এ বাসায় থাকে। কখনো ছেলেটিকে কোনো উচ্চবাচ্চ করতে দেখিনি। অত্যন্ত ভদ্র ছিল ছেলেটি।’
হৃদয়ের বন্ধু রাকিবুল ইসলাম রাহাত বলে, ‘আমাদের মধ্যে ওই (হৃদয়) ছিল সবচেয়ে মেধাবী। আজও (গতকাল) সকালে দেখা হয়েছে। একই সঙ্গে ফল আনতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে বলল খেলা শেষে ফল আনতে যাবে। ওকে যদি তখন খেলতে না যেতে দিতাম, তাহলে হয়তো এমনটা হতো না।’
হৃদয়ের মা তাজেরা বেগমের আর্তনাদ থামানোই যাচ্ছিল না। আত্মীয়স্বজনকে ডেকে ডেকে বলছিলেন হৃদয়কে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা। তার এমন আচরণে চোখ মুছছিলেন অনেকেই।
এসএসসি পরীক্ষার পর তাবলিগ জামাতে ৪০ দিনের জন্য চিল্লায় গিয়েছিল হৃদয়। গত ২৬ এপ্রিল তা শেষ হয়। ওই দিন ফেসবুকে হৃদয় লিখেছিল, ‘৪০ দিন চিল্লা শেষ করে ঢাকা ফিরছি...কত দিন বাবা-মার সাথে দেখা হয় না। বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা হয় না। একবার বাসায় যেয়ে নেই, মজা শুরু হবে..।’ হৃদয়ের সেই মজা বেশি দিন স্থায়ী হলো না। মাত্র ১৫ দিনের মাথায় সে এসবের ওপরে চলে গেল।
মিরপুর মডেল থানার উপপরিদর্শক মো. আরিফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ওই ঘটনায় হৃদয়ের তিন বন্ধুকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।