সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষণ নেই

কার্টুন : শিশির
কার্টুন : শিশির

নারায়ণগঞ্জের সাংসদ সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার তাঁর দল জাতীয় পার্টির। আর আইন হাতে তুলে নেওয়ার অপরাধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।
তবে এখন পর্যন্ত সরকার বা দল কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে না। ভুক্তভোগী প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তও গতকাল শনিবার পর্যন্ত মামলার সিদ্ধান্ত নেননি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি একজন সাধারণ শিক্ষক এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি। আমার অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক—কোনো শক্তিই নেই। আমার পাশে যাঁরা আছেন, তাঁদের কোটি কোটি সালাম।’
১৩ মে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সাংসদ সেলিম ওসমান নিজে পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ে উপস্থিত থেকে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরিয়ে ওঠবস করান। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ আইনমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অপরাধ হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নে আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ, অপরাধ হয়েছে। এখন এই অপরাধের প্রতিকার চেয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা অন্য কেউ মামলা করতে পারেন।’ তিনি বলেন, সরকার তো এখানে মামলা করতে পারে না। মামলা হলে তা আইনি প্রক্রিয়ায় চলবে, সেখানে সহায়তার দরকার হলে সরকার তা করবে।
অবশ্য সাংসদ সেলিম ওসমানসহ জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। এর জবাব পেয়ে আদালত পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।
এ পরিস্থিতিতে সাংসদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে, সংবিধানে তার উল্লেখ নেই। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দুই বছরের বেশি শাস্তি হলে সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। কিন্তু সেই শাস্তির জন্য প্রচলিত আইনে কাউকে মামলা করতে হবে। এ ছাড়া কেউ প্রশ্ন তুললে তা নিয়ে সংসদে আলোচনা বা নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হতে পারে।
জানতে চাইলে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বিষয়টি তদন্ত করে যতটুকু করা উচিত, তা করছে। সারা দেশের মানুষ ওই সাংসদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। এটাকে সাম্প্রদায়িক ইস্যু করতে কারও কারও চেষ্টা সফল হয়নি। এখন সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা তাঁর দল জাতীয় পার্টির হাতে। এ ছাড়া আছে আইনি প্রক্রিয়া।
দল কেন নীরব, জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, সম্মেলন হওয়ার পর জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এখনো গঠিত হয়নি। কমিটি গঠনের আগে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে জি এম কাদের বলেন, বিষয়টি দলের কিছু নয়, একজন সাংসদের ব্যক্তিগত দায়দায়িত্বের বিষয়। এখন দলের কিছু করার আছে কি না, তা দলীয় ফোরামেই সিদ্ধান্ত হতে হবে। আর সে জন্য দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থাকতে হবে।
কেন্দ্রীয় কমিটি কবে হবে, জানতে চাইলে জি এম কাদের বলেন, এত তাড়াহুড়োর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এটা নিয়ে কাজ চলছে। সরকার তদন্ত করে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে, আদালত রুল দিয়েছেন। জাতীয় পার্টি সব তথ্য-উপাত্ত বিবেচনায় নিয়ে ধীরেসুস্থে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জাপা নেতৃত্বের কাছে বলেছি, জাপা নেতা হিসেবে ওই সাংসদ দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। তাই দলের উচিত সাংগঠনিকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করা।’
কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে তদন্ত করেছে, তাতে সেলিম ওসমানের কোনো প্রসঙ্গ নেই। ওই তদন্ত হয়েছে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি ও প্রধান শিক্ষককে অপসারণ বিষয়ে। সেখানে সাংসদ সেলিম ওসমানের বিষয়ে তদন্তের এখতিয়ার ওই কমিটির নেই।
এ প্রসঙ্গে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘ঘটনার পর আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, ওই সাংসদ যা করেছেন, তা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা চাই, মন্ত্রী যে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন, তা দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করা হোক। তাহলে জনজীবনে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসবে। মানুষ ভাববে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’
সরকার বিব্রত: সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক মন্ত্রী-নেতা বলেন, অন্য দলের হলেও একজন সাংসদের এমন আচরণে সরকার বিব্রত। বিশেষ করে তিনি ক্ষমা চাইবেন না, কার কাছে ক্ষমা চাইবেন, তিনি না থাকলে উত্তেজিত জনতার হাত থেকে শিক্ষক বাঁচতে পারতেন না, শিক্ষক নিজেই কান ধরেছেন—এসব বক্তব্য সরকারের নেতা, মন্ত্রী থেকে সাধারণ মানুষও ভালোভাবে নেননি। এমন বক্তব্যকে ‘দম্ভোক্তি’ বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
এর আগে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সরকারদলীয় কয়েকজন নেতা সেলিম ওসমানের কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেন।