প্রাণ গেল আরও চারজনের

চট্টগ্রামের সাগরিকা মোড় এলাকায় গতকাল পুলিশের সঙ্গে অবরোধকারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। এ সময় অবরোধকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ছুড়ে মারেন। ঘরের চালের ওপর পড়ে আছে একটি অবিস্ফোরিত ককটেল (লাল চিহ্নিত) ষ ছবি: প্রথম আলো
চট্টগ্রামের সাগরিকা মোড় এলাকায় গতকাল পুলিশের সঙ্গে অবরোধকারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। এ সময় অবরোধকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ছুড়ে মারেন। ঘরের চালের ওপর পড়ে আছে একটি অবিস্ফোরিত ককটেল (লাল চিহ্নিত) ষ ছবি: প্রথম আলো

সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের ডাকা দ্বিতীয় দফা অবরোধের প্রথম দিন গতকাল শনিবার প্রাণ গেল আরও চারজনের। এর মধ্যে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে ছাত্রশিবিরের এক কর্মী এবং পাবনার ঈশ্বরদীতে যুবদলের এক কর্মী নিহত হন। এ ছাড়া রাজধানীর মালিবাগে ও চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় নিহত হন দুজন পথচারী। এ নিয়ে দুই দফায় অবরোধের ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রাণ গেল মোট ২৬ জনের।

গত শুক্রবার রাত ১০টার দিকে দ্বিতীয় দফা ৭২ ঘণ্টার অবরোধের ঘোষণা আসে। আকস্মিক এ ঘোষণায় রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের কারণে ঘরের বাইরে থাকা মানুষ পড়েন চরম দুর্ভোগে। এর সঙ্গে যোগ হয় যথারীতি গুলি, ককটেল, ভাঙচুর ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও অবরোধকারীদের মধ্যে সংঘর্ষও হয়েছে।

রাজধানীর মালিবাগে গতকাল রাতে একটি যাত্রীবাহী বাসকে লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। এতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসের চাপায় মারা যান হাবিবুর রহমান (৩২) নামের এক পথচারী। আহত হন পাঁচজন। তবে তাঁরা বাসযাত্রী না পথচারী, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মারুফ হোসেন প্রথম আলোকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

পুলিশ জানায়, রাত আটটার দিকে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় রামপুরাগামী সুপ্রভাত পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা ছুড়লে এতে আগুন ধরে যায়। আতঙ্কিত হয়ে চালক বাসের গতি বাড়িয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করার সময় কয়েকজন পথচারীকে ধাক্কা দেন। আহত ব্যক্তিদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক হাবিবুরকে মৃত ঘোষণা করেন।

হাবিবুরের ভাই মো. বাচ্চু জানান, স্টেডিয়াম মার্কেটে হাবিবুরের একটি সিডির দোকান আছে। উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টর এলাকায় থাকেন। গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ সদরে। বাবা আক্কাছ আলী শেখ। কয়েক মাস আগে বিয়ে হয় হাবিবুরের।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আইনজীবী গোলাম কিবরিয়ার হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তিনি মিরপুরের বাসিন্দা। পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়েছেন গুলশানের কালাচাঁদপুরে সোনার দোকানের কারিগর রেজাউল করিম। তাঁর শরীরের সাত ভাগ পুড়ে গেছে। এলিফ্যান্ট রোডে তৈরি পোশাকের দোকানের কর্মচারী এহসানুল হাসানও একই পরিমাণ দগ্ধ হয়েছেন।

সদরঘাটের পোশাকের দোকানের মালিক মহিউদ্দিনের বাঁ পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। তিনি পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে আহত হন চালকের সহকারী মনির।

রাজধানীর গ্রিন রোড, রামপুরা ও গাবতলী পুলিশ ফাঁড়ির কাছে ককটেল ফাটান অবরোধকারীরা। গ্রিন রোডে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়ে শিবিরের কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। গাবতলী ও সেনপাড়া পর্বতা এলাকা থেকে আটক হন চারজন।

পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকায় শিবির ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ ফাঁকা গুলি করলে শিবিরের কর্মীরা পালিয়ে যান। আমিনবাজার-সংলগ্ন সালেহপুর সেতুর কাছে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন ১৮ দলের কর্মীরা। এ সময় ঢাকা থেকে সাভার ও ধামরাইগামী কিছু যান আটকা পড়ে। পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে অবরোধকারীরা পালিয়ে যান এবং গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হয়। গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি।

কেরানীগঞ্জের জিনজিরায় অবরোধকারী ও পুলিশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। টঙ্গীর কলেজগেট এলাকায় গাড়ি ভাঙচুরের সময় জামায়াত-সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। মুন্সিগঞ্জের নিমতলীতে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে ছয়টি বাস ভাঙচুর করেন অবরোধকারীরা। নারায়ণগঞ্জে ঘটানো হয় বোমার বিস্ফোরণ।

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় অবরোধকারীদের ধাওয়া খেয়ে একটি পিকআপ ভ্যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পথচারী নিমাই নাথকে (৪৫) ধাক্কা দেয়। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের উপজেলার নয়াখাল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রাম মহানগরে পুলিশ ও অবরোধকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে পুলিশের তিন সদস্যসহ ১০ জন আহত হন। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এ কে খান মোড়ে অবরোধকারীদের গুলিতে কনস্টেবল আনিসুর রহমান ও রাহুল বড়ুয়া আহত হন। এ ছাড়া বহদ্দারহাটে ককটেলে আহত হন পুলিশের সদস্য অঞ্জন চৌধুরী।

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা সদরের প্রধান বাসস্ট্যান্ডে ১৮-দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা সকাল ১০টার দিকে পাঁচটি মাইক্রোবাস ভাঙচুর করেন ও ককটেল ফাটান। পুলিশ এগিয়ে এলে দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়। গুলিতে শিবিরের কর্মী ইসরাইল হোসেন (২৩) নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর প্রতিবাদে আজ রোববার কোটচাঁদপুর ও মহেশপুর উপজেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকা হয়েছে।

পাবনার ঈশ্বরদীতে নিহত হয়েছেন যুবদলের কর্মী মাহাবুল আলম (৪০)। সন্ধ্যায় উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের মিরকামারী মুন্নার মোড়ে অবরোধকারীরা একটি ট্রাক ধাওয়া করে। এ সময় ট্রাকের চাপায় মাহাবুল নিহত হন। ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা ট্রাকটি পুড়িয়ে দেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পাওয়ার হাউস রোড এলাকায় পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে বিএনপির কর্মীরা অর্ধশতাধিক ককটেল ফাটান। সংঘর্ষে কনস্টেবল আরিফ রব্বানিসহ ১৫ জন আহত হন। তেতৈয়া এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর করেন অবরোধকারীরা।

জামালপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কের জামালপুর ফেরিঘাট এলাকায় একটি বিয়ের গাড়িবহরে বিএনপির কর্মীরা হামলা চালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

এ ছাড়া যশোর-বেনাপোল সড়কের নতুনহাট এলাকা, মাগুরার পারনান্দুয়ালি কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, খুলনা, সাতক্ষীরার তালা, সিরাজগঞ্জের পৌর এলাকা, মৌলভীবাজারের বড়লেখা, চাঁদপুর শহরসহ বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, আঞ্চলিক কার্যালয় ও প্রতিনিধিরা]