তদন্ত প্রতিবেদন ও সাক্ষীতে আটকে আছে ২৩৪ মামলা

পাহাড় কেটে আবাসিক প্লট তৈরি করার অভিযোগে নয় বছর আগে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ আদালতে একটি মামলা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী আসামির ১০ বছরের কারাদণ্ড হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মামলার তদন্ত প্রতিবেদনই জমা দেওয়া হয়নি।
চট্টগ্রাম নগরের আকবর শাহ আবাসিক এলাকায় সরকারি পাহাড় কেটে প্লট তৈরি করার অভিযোগে ২০০৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর খুলশী থানায় স্থানীয় বাসিন্দা খুরশিদ জাহানের বিরুদ্ধে পরিবেশ আদালতে ওই মামলাটি করা হয়। বাদী চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক সাইফুল আশ্রাব। তদন্ত প্রতিবেদন দিতে গত কয়েক বছরে একাধিকবার পরিবেশ আদালত থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। গত নয় বছরে মামলার অগ্রগতি বলতে এটুকুই।
পাহাড় কাটা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ রসায়নবিদ কামরুল হাসান ২০১৪ সালের ৩ এপ্রিল আদালতকে লিখিতভাবে জানান, তদন্তে তাঁর আরও তিন মাস সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু দুই বছর পরও তিনি প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি। গত শুক্রবার রাতে কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত কাজ শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দিয়ে দিব।’ তিনি বলেন, তাঁর আগে অধিদপ্তরের আরও পাঁচজন কর্মকর্তা এই মামলা তদন্ত করেন। ২০১৩ সালের শেষের দিকে মামলাটি তদন্তের জন্য তাঁর কাছে আসে।
সর্বশেষ গত ২৪ মে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ আদালতে এই মামলার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু প্রতিবেদন না আসায় আদালত আগামী ৮ জুন পরবর্তী দিন ধার্য করেন। গত নয় বছরে এ মামলার তারিখ পড়েছে ৫৫ বার। মামলা করার কিছুদিন পর জামিন নেন খুরশিদ জাহান।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মকবুল হোসেন বলেন, লোকবল-সংকটের কারণে অনেক মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে দেরি হয়। তবে পুরোনো মামলাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন যাতে দ্রুত দেওয়া যায়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রতিবেদন দিতে দেরি করায় অনেক তদন্ত কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
শুধু এই একটি মামলা নয়, চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন আসায় বছরের পর বছর ধরে ১৫৯টি মামলার কেবল তারিখই পড়ছে। সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে আরও ৭৫টি মামলা। ২০১৪ সালের মে মাস থেকে চলতি বছরে মে মাস পর্যন্ত গত এক বছরে বিভাগীয় পরিবেশ আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৪টি মামলা। এর মধ্যে তিনটি মামলায় সাজা হলেও বাকি ১১টি মামলায় খালাস পান আসামিরা। একজন যুগ্ম জেলা জজ আদালতের বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। থানায় মামলা করা হলেও তদন্ত করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক থেকে শুরু করে সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত কর্মকর্তারা আদালতে প্রতিবেদন জমা না দেওয়ায় বছরের পর বছর বেশির ভাগ মামলার বিচার ঝুলে থাকে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও সাক্ষ্য দিতে ঠিকমতো আদালতে হাজির হন না।
২০০২ সালের মার্চে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ আদালত প্রতিষ্ঠার পর গত ১৪ বছরে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৫৪টি মামলা। বর্তমানে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুরসহ ১১ জেলার ২৩৪টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
পরিবেশ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ছাড়াও যেকোনো নাগরিক পরিবেশ আদালতে মামলা করতে পারেন। তবে অভিযোগটি লিখিতভাবে আগে পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানাতে হবে। অধিদপ্তর ৬০ দিনের মধ্যে কোনো ব্যবস্থা না নিলে অভিযোগের অনুলিপি নিয়ে পরিবেশ আদালতে মামলা করতে পারবেন ওই ব্যক্তি। তিনি বলেন, গত পাঁচ মাসে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ আদালতে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বাইরে তিনজন ব্যক্তি মামলা করেছেন। দূষণ, পুকুর ভরাটের অভিযোগে এসব মামলা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
পরিবেশ আদালতের কৌঁসুলিরা বলেন, পোলট্রি দূষণের অভিযোগে করা এক মামলায় সাড়ে পাঁচ বছরে একজন সাক্ষীও আদালতে হাজির হননি। খোদ মামলার বাদী পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের সাবেক জ্যেষ্ঠ রসায়নবিদ আসাদুল হকও সাক্ষ্য দেননি। গত ২৬ মে এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য ছিল। কোনো সাক্ষী হাজির না হওয়ায় আদালত আগামী ২৯ জুন পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন।
জানতে চাইলে আসাদুল হক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এখন অবসর জীবনে রয়েছেন। সাক্ষ্য দিতে হাজির হওয়ার জন্য তিনি কোনো সমন পাননি।
পরিবেশের ক্ষতি এবং ক্ষতি হতে পারে—এমন যেকোনো বিষয়ে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বাদী হয়ে মামলা করতে পারবেন বলে জানান চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মকবুল হোসেন। তিনি বলেন, ইটভাটায় দূষণ, পাহাড় কাটা ছাড়াও কারখানায় পরিবেশের ছাড়পত্র না থাকলে কিংবা ছাড়পত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও অধিদপ্তর মামলা করতে পারে। বিভাগীয় পরিবেশ আদালতে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকার পরিবেশ আপিল আদালতে আপিল করতে পারবেন সাজা পাওয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান।