'আমরা অসুস্থ সরকার চাই না'

শরীর পুড়েছে গীতা সরকারের। মনে জমেছে ক্ষোভের আগুন। গতকাল ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে সহিংস রাজনীতি নিয়ে ক্ষোভের কথা জানাতে ভোলেননি তিনি। শাহবাগে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় মেয়েসহ গুরুতর দগ্ধ হন তিনি ষ ছবি: প্রথম আলো
শরীর পুড়েছে গীতা সরকারের। মনে জমেছে ক্ষোভের আগুন। গতকাল ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে সহিংস রাজনীতি নিয়ে ক্ষোভের কথা জানাতে ভোলেননি তিনি। শাহবাগে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় মেয়েসহ গুরুতর দগ্ধ হন তিনি ষ ছবি: প্রথম আলো

আমরা আপনাদের তৈরি করছি, আপনারা আমাদের তৈরি করেন নাই। আমরা আমাদের স্বামীরটা খাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন।... আমরা ভালো সরকার চাই...আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।’
কাঁদতে কাঁদতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এভাবেই আকুতি আর তীব্র ক্ষোভের কথা জানালেন অবরোধের সময় বাসে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ গৃহবধূ গীতা সরকার।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে নাশকতার আগুনে পোড়া মানুষগুলোকে দেখতে যান। তাঁদের চিকিৎসার খোঁজ নেন ও সান্ত্বনা দেন। এ সময় গীতা সরকার প্রধানমন্ত্রীর সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে ক্ষোভের কথা বলতে থাকেন। সাংবাদিকেরা প্রধানমন্ত্রী ও গীতার এই কথোপকথন ধারণ করে—
গীতা: ‘ওরা যে বোমগুলো মারে বা যাই মারে, ওদের শনাক্ত করুন এবং যারা অর্ডার দেয় তাদের পরিবারের লোককে ধরে ধরে আপনারা আগুনে পুড়িয়ে দেন। ওরা অর্ডার দিতে পারে, আমাদের তো রক্ষা করতে পারে না। আমাদের জন্য আপনারা সরকার।’
প্রধানমন্ত্রী: ‘এই জিনিসটা কখনো দেখি নাই...’
গীতা: ‘আমরা আপনাদের তৈরি করছি, আপনারা আমাদের তৈরি করেন নাই। আমাদের স্বামীরটা আমরা খাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। ওনারে এক হইতে বলেন, আপনারা সবাই এক হন। হয়ে আমাদের রক্ষা করেন।’
প্রধানমন্ত্রী: ‘এভাবে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ায়া মারা, এটা তো কোনো আন্দোলন না...কিছু না।
এটা আমার জীবনে আমি কখনো দেখি নাই। বহু আন্দোলন-সংগ্রাম আমি দেখছি, কিন্তু এভাবে দেখি নাই যে সাধারণ মানুষকে এভাবে পোড়ায়া মারতেছে...।’
গীতা: ‘যারা বলে হরতাল দিবো, তাদের সাথে...হরতালের যে যে ঘটনা হয়, তাদের পরিবারের সাথে সেটা হোক। আপনারা সেটাই এখন করেন...’

প্রধানমন্ত্রী: ‘ধৈর্য ধরেন...’

গীতা: ‘না আপা...আমার...’

প্রধানমন্ত্রী: ‘আমরা আছি...’

গীতা: ‘আমার স্বামীর পক্ষে তো আমার এইগুলা (চিকিৎসা) করা সম্ভব না...’

প্রধানমন্ত্রী: ‘না, যা ট্রিটমেন্ট লাগে আমরা ব্যবস্থা করে দিবো। আমি করতেছি, যখনই খবর পাবো...’

গীতা: ‘আমার সংসারে তো ছেলে নাই, আমার দুইটা মেয়ে, আমার কে দেখবে এগুলা...’

প্রধানমন্ত্রী: ‘আপনি কান্না কইরেন না...’

গীতা: ‘আমরা ভালো সরকার চাই...আমরা অসুস্থ সরকার চাই না। আমরা ভালো সরকার চাই...আমরা অসুস্থ সরকার চাই না...’

প্রধানমন্ত্রী: ‘এটা তো সরকারের...’

গীতা: ‘আমরা অসুস্থভাবে আমাদের সন্তানকে বড় করতে চাই না। আমরা আর অসুস্থ থাকতে চাই না। আমরা একটা ভালো সরকার চাই। ওরা কেন আমাদের মারে? আমরা তো ওদের ক্ষতি করি নাই। আমরা তো কিচ্ছু করি নাই, আমরা তো যাচ্ছিলাম, আমরা তো ওদের চিনিও না। আমরা খালেদারেও চিনি না, হাসিনার কাছেও যাই না। আমরা যার যার সংসার নিয়ে থাকি, আমাদের কেন মারে ওরা?...দিদি, আপনি এগুলার বিচার করেন, এগুলার বিচার করেন, আর সহ্য হয় না। কতলোক এইখানে আছে, আমরা সবাই অসুস্থ...। আমরা এখন খালি আগুন, আগুন ভয় লাগে, আমরা আগুন দেখলে এখন ভয় লাগে, মনে হয় আগুন জ্বলতেছে আমার সামনে...। ওরা আমাদের এই কষ্ট বোঝে না...’

গীতা সরকারের স্বামী গোপাল সরকার বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির কারিগর। দুই মেয়েকে নিয়ে পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে তাঁদের বাস। এই দম্পতির ছোট মেয়ে সুস্মিতা সরকার বেসরকারি টেলিভিশন ইটিভির মুক্ত খবর অনুষ্ঠানের খুদে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করে। বৃহস্পতিবার সুস্মিতাকে নিয়ে বিহঙ্গ বাসে চড়ে কারওয়ান বাজারে ইটিভির কার্যালয়ে যাচ্ছিলেন গীতা। এর মধ্যেই দুর্বৃত্তদের ছুড়ে মারা আগুনে পুড়ে যান বাসযাত্রী গীতা-সুস্মিতাসহ ১৯ জন। এর মধ্যে দুজন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। আগুনে ১৪ জনের শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা পুড়ে গেছে। এঁদের সবার অবস্থাই আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।