অবরোধের রাতে রেলে আতঙ্ক

রাজশাহীর চারখুটা এলাকায় গতকাল পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন ১৮-দলীয় জোটের কর্মীরা ষ প্রথম আলো
রাজশাহীর চারখুটা এলাকায় গতকাল পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন ১৮-দলীয় জোটের কর্মীরা ষ প্রথম আলো

অবরোধের রাত রেলের জন্য আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দলের দুই দফার অবরোধে গতকাল সোমবার পর্যন্ত রেললাইন, ট্রেন ও রেলস্টেশনে যেসব বড় নাশকতা ঘটেছে, এর প্রায় সবই হয়েছে রাতে। গত ২৫ নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত অবরোধ চলাকালে নাশকতার কারণে প্রায় প্রতি রাতেই কোনো না কোনো ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। আহত হয়েছেন যাত্রীরা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অব্যাহত নাশকতার কারণে রেল সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। এক স্থানে লাইন মেরামতের পর অন্য স্থানে লাইন খুলে নেওয়া হচ্ছে। লাইন থেকে ছিটকে পড়া একটি ট্রেনের ইঞ্জিন-বগি উদ্ধার করার আগেই অন্য স্থানে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার খবর আসছে। প্রায় প্রতিদিন এমন ঘটনায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন রেলের কর্মকর্তারা।
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার রাজাপুর রেলস্টেশনের অদূরে সিন্দুরিয়া সেতুর কাছে রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলায় গত রোববার রাত পৌনে আটটার দিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী মহানগর গোধূলী ট্রেনের ইঞ্জিন ও ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে শতাধিক যাত্রী আহত হন। এ ঘটনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম-সিলেট পথে ১৯ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। লাইনচ্যুত বগি উদ্ধার ও লাইন মেরামত করার পর গতকাল বিকেল চারটার দিকে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
ঘটনাস্থলে যাওয়া কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে মন্ত্রণালয় থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

রেলে নাশকতা
রেলে নাশকতা


এদিকে কুমিল্লার যে আট উপজেলায় রেললাইন রয়েছে সেসব রেললাইনের নিরাপত্তার লক্ষ্যে গতকাল কমিটি গঠন করা হয়েছে। উপজেলাগুলো হলো ব্রাহ্মণপাড়া, বুড়িচং, আদর্শ সদর, সদর দক্ষিণ, লাকসাম, নাঙ্গলকোট, চৌদ্দগ্রাম ও মনোহরগঞ্জ। এসব কমিটির সভাপতি করা হয়েছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে। জেলা প্রশাসক কমিটি গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জামালপুরের সরিষাবাড়ীর বারইপটল ও হেমনগর এলাকায় রোববার গভীর রাতে প্রায় ১৬৮ হাত রেললাইনের ফিশপ্লেট ও ক্লিপ খুলে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এতে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থেকে সরিষাবাড়ী হয়ে ঢাকায় যাওয়ার ওই রেলপথ ১৫ ঘণ্টায় মেরামত করা হয়। এতে আন্তনগর অগ্নিবীণা ও যমুনাসহ পাঁচটি ট্রেনের চলাচল বন্ধ থাকে। রেলের কর্মকর্তারা জানান, বারইপটলে রেললাইন ও ক্লিপ খুলে সেগুলো পাশের জলাশয়ে ফেলে দেন অবরোধকারীরা। হেমনগরে ক্লিপ খুলে রেললাইন বাঁকা করে ফেলা হয়।
গাজীপুরের জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশন এলাকায় রোববার রাত নয়টার দিকে তুরাগ এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনে পেট্রলবোমা ও পাথর নিক্ষেপ করা হয়। এতে ওই ট্রেনের চালক মুজিবুর রহমান ও জয়দেবপুর জংশনের পয়েন্টসম্যান আবদুল বাতেন আহত হন। তুরাগ এক্সপ্রেস ঢাকা-জয়দেবপুর পথে কমিউটার ট্রেন হিসেবে চলাচল করে।
জয়দেবপুর জংশনের মাস্টার জিয়া উদ্দিন সরদার বলেন, ফিরতি যাত্রার জন্য ট্রেনের ইঞ্জিন ঘোরাতে জংশনের দক্ষিণ পাশে গেলে পেট্রলবোমা ও পাথর নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। এতে ট্রেনের হুসপাইপ পুড়ে যায়।
রোববার ভোররাতে ঢাকা-ঈশ্বরদী রেলপথের কৈডাঙ্গায় স্লিপার তুলে ফেললে এই পথে প্রায় আট ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল মান্নান বলেন, কৈডাঙ্গায় ২৪ ও ২৫ নম্বর রেল সেতুর মাঝামাঝি অবরোধকারীরা রেললাইনের ২০টি স্লিপার তুলে ফেলে। ফলে দুপুর পর্যন্ত উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী সব ট্রেনের চলাচল বন্ধ ছিল।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার সরারচর রেলস্টেশন অবরোধ করে ১৮-দলীয় জোটের সমর্থকেরা। একপর্যায়ে তারা রেললাইনের স্লিপারে আগুন দেয় এবং স্টেশনমাস্টার চন্দন কুমার সাহাকে তাঁর কক্ষে তালা মেরে আটকে রাখেন। পুলিশ এসে তাঁকে উদ্ধার করে এবং অবরোধকারীদের হটিয়ে দেয়। এ সময় দুটি ট্রেন আটকা পড়ে।
বগুড়ার আদমদীঘির ডাঙ্গাপাড়ায় রোববার রাতে রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলে দুর্বৃত্তরা। দুই ঘণ্টা চেষ্টা করে লাইন মেরামত করা হয়।
শনিবার রাত পৌনে দুইটার দিকে রাজশাহীর নন্দনগাছী স্টেশনের কাছে ঢাকামুখী আন্তনগর ধূমকেতু এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন ও পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এর পর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাদে রাজশাহীর সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ প্রায় ৩০ ঘণ্টা বিচ্ছিন্ন থাকে।
এ ঘটনায় রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জিআরপি পুলিশ ঈশ্বরদী থানায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেছে। এ মামলায় রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার হলিদাগাছি গ্রামের রাজীব আহাম্মেদ ও আকবর আলী নামে দুই জামায়াত-শিবির কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঈশ্বরদী জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এনামূল হক বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১৫০ জনের নামে এই মামলা করা হয়েছে। আসামিদের সবাই ১৮ দলের নেতা-কর্মী।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কুমিল্লা, রাজশাহী, কিশোরগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ এবং বগুড়া, গাজীপুর ও জামালপুর প্রতিনিধি]