প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা একটি ভবন

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম মদনেরপাড়ায় ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার নামক ভবনের পুরোটা মাটির তলায়। ভবনের বিভিন্ন কক্ষের ছাদের মাটিতে ঘাস l প্রথম আলো
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম মদনেরপাড়ায় ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার নামক ভবনের পুরোটা মাটির তলায়। ভবনের বিভিন্ন কক্ষের ছাদের মাটিতে ঘাস l প্রথম আলো

একাধিক ব্লকে বিভক্ত একটি ভবন। তাতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, লাইব্রেরি, অভ্যন্তরীণ খেলাধুলা ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। একটির সঙ্গে আরেকটি সংযুক্ত বারান্দা ও খোলা প্যাভিলিয়ন দিয়ে। বিশাল ভবন। কিন্তু পুরো ভবনটিই দৃষ্টির আড়ালে। পাশ দিয়ে চলে গেছে গ্রাম্য সড়ক। অথচ সেখানে দাঁড়িয়ে ভবনটি চোখেই পড়বে না। কারণ, পুরো ভবনটি মাটির তলায়।
ভবনের বিভিন্ন কক্ষের ছাদ মাটির সমতলে। তাতে লাগানো সবুজ ঘাস মিশে গেছে আশপাশের মাঠের সঙ্গে। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের মদনেরপাড়া গ্রামে ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার নামক এই ভবনের দিকে সবাই অবাক হয়ে তাকায়। প্রকৃতির মধ্যে মিশে যেন অদৃশ্য হয়ে আছে কমপ্লেক্সটি।
গাইবান্ধা-বালাসী সড়ক ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই ভবনের আয়তন ৩২ হাজার বর্গফুট। স্থানীয়ভাবে তৈরি ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত ভবনটি দেখতে প্রতিদিনই কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমে।
মদনেরপাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান বলেন, বাইরে থেকে অনেক লোক ভবন দেখতে আসার কারণে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জিনিসপত্রের বিক্রি বেড়েছে। কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের সমিতির বাজার গ্রামের কলেজশিক্ষক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নদীভাঙনকবলিত এই প্রত্যন্ত এলাকায় এমন একটি ব্যতিক্রমী স্থাপনা এলাকার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক গুণ।

স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী
স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী

আধুনিক ও চৌকস স্থাপত্যশৈলীর এই ভবন এবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিল। সারা বিশ্বের সম্মানজনক আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় এবার বাংলাদেশের যে দুটি স্থাপনা মনোনয়ন পেয়েছে, এটি তার একটি। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের (একেডিএন) পুরস্কারের জন্য বিশ্বের ৩৮৪টি স্থাপনাকে পেছনে ফেলে সেরা ১৯ স্থাপনার তালিকায় রয়েছে ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার। এটির স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী।
তরুণ স্থপতিদের উদ্ভাবনী ধারণাকে স্বীকৃতি দিতে আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক প্রতি তিন বছর পরপর এই পুরস্কার দেয়। অনেক বিষয় এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়। উদ্ভাবনী আইডিয়ার পাশাপাশি স্থাপনাটি কতটা পরিবেশবান্ধব, সেটি দেখা হয়। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে এটির যোগসূত্রও বিবেচনা করা হয়।
ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বল্প বাজেটে প্রকল্পটি নির্মাণের চিন্তা ছিল। কম খরচের চিন্তা আর চাপের কারণে চমৎকার এই সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে।’ এই ভবনের অনুপ্রেরণা বৌদ্ধবিহারের ধারণা থেকে এসেছে বলে জানালেন তিনি। ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের ভবনটি ওপর দিক থেকে দেখলে মহাস্থানগড়ের প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের ছবি ফুটে ওঠে অনেকটা।
ভবনের বিশেষত্ব জানতে চাইলে তরুণ এই স্থপতি বলেন, ‘ভবনের জমি খুবই নিচু ছিল। পানি আটকাতে চারদিকে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ভবনের ছাদের লেভেল রাস্তার প্রায় সমতলে। আমার লক্ষ্য ছিল অল্প খরচে সবার জন্য ভিন্নধর্মী কিছু একটা করা। এটি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যালয়। সংস্থাটি চরের মানুষের জন্য কাজ করে। সেখানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পাশাপাশি চরের মানুষজনের জন্য সেবা দেওয়ার বিষয়টি রয়েছে। তাই সেখানে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিদেশি দাতা সংস্থার লোকজন আসবেন, থাকবেন—সেটাও একটি বিষয়। সবাই যাতে ভবনে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে পারেন, সেটাও মাথায় রাখতে হয়েছে।’
কাশেফ মাহবুব চৌধুরী জানালেন, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে এটা ব্যবহৃত হবে জেনে নিরিবিলি ও শান্ত একটি পরিবেশ তৈরির বিষয়টি ভাবা হয়েছে। পর্যাপ্ত আলো আর বাতাসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে দেশি উপকরণ।
ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, এই ভবন নির্মাণে খরচ হয়েছে আনুমানিক আট কোটি টাকা। নির্মাণকাজ শেষ করতে সময় লেগেছে প্রায় দুই বছর। প্রতিষ্ঠানটি মনে করছে, মাটি ভরাট করে ভবন নির্মাণ করতে গেলে বাজেটের ৬০ শতাংশই শেষ হয়ে যেত। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান গ্রামে হওয়ার কারণে সেখানে দোতলা ভবন করলে গ্রামের পরিবেশের সঙ্গে মিলত না। তাই সমতল ভূমির সঙ্গে মিল রেখে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এতে গ্রামের প্রকৃতির অংশ হয়ে উঠেছে ভবনটি।
ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের সহকারী ব্যবস্থাপক লোকমান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মাটির নিচে ভবনের কক্ষ অনেকটা ঠান্ডা থাকে। বাইরের আলো-বাতাসও পাওয়া যায়। এটি পরিবেশবান্ধব কার্যালয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক স্থপতি শামসুল ওয়ারেস প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার স্থাপনাটি একটি মৌলিক কাজ। আলোছায়ার খেলা রয়েছে সেখানে। আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতিতে বাড়ির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ উঠান। এই ভবনে উঠানের অংশ রাখা হয়েছে।’

স্থাপত্য সৌন্দর্যের কারণে এ বছর আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার। হেলিকপ্টার থেকে তোলা l ছবি: সংগৃহীত
স্থাপত্য সৌন্দর্যের কারণে এ বছর আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার। হেলিকপ্টার থেকে তোলা l ছবি: সংগৃহীত

কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ১৯৯৫ সালে বুয়েট থেকে স্নাতক শেষ করে স্থাপত্য পেশায় যোগ দেন। আরেক স্থপতি মেরিনা তাবাসসুমের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন আরবানা। দুজনে যৌথভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘরের নকশা করেছেন। এখন কাশেফ মাহবুবই আরবানার একক প্রধান। এর আগেও আগা খান পুরস্কারের জন্য দুবার মনোনীত হয়েছিলেন কাশেফ। ২০০৪ সালে মেরিনা তাবাসসুমের সঙ্গে যৌথভাবে একটি প্রকল্পের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন। চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে নির্মিত একটি মসজিদের জন্য ২০১০ সালে এককভাবে মনোনয়ন পান আগা খান পুরস্কারের জন্য।
মেরিনা তাবাসসুমের করা অনন্য স্থাপত্যশৈলীর বায়তুর রউফ মসজিদটিও এবার আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় মনোনয়ন পেয়েছে। রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় এই মসজিদটি অবস্থিত।