মহাসড়কের ৭১.৩১ শতাংশই ভালো, তবু ভোগান্তির শঙ্কা

দুয়ারে ঈদ, প্রস্তুতি সর্বত্র। এরপরও ঈদযাত্রায় নির্বিঘ্নে সড়ক-মহাসড়ক পাড়ি দেওয়া নিয়ে শঙ্কায় ঘরমুখী মানুষ। কারণ, দুটি মহাসড়কে এখনই মাঝেমধ্যে সৃষ্টি হওয়া যানজট।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) সমীক্ষা বলছে, জাতীয় মহাসড়কের ৭১ দশমিক ৩১ শতাংশই এবার ভালো ও চলনসই। বাকি প্রায় ২৯ শতাংশ খারাপ ও বেহাল। এই খারাপ অংশই ভারী বর্ষা, অত্যধিক গাড়ির চাপ কিংবা দুর্ঘটনায় মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলতে পারে বলে মনে করছেন সওজের কর্মকর্তারা।

সওজ সূত্র বলেছে, এবার সারা দেশের সড়ক তুলনামূলকভাবে ভালো। তবে সম্প্রসারণ, নির্মাণ ও মেরামতকাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি মহাসড়কে ইতিমধ্যে ভোগান্তি চলছে। ঈদে তা বাড়তে পারে। আর দুটি মহাসড়কে চার লেনের কাজ শেষ হয়েও শেষ না হওয়ায় পুরো সুফল পাচ্ছে না ব্যবহারকারীরা।

ঢাকা-উত্তরবঙ্গ পথের ভোগান্তির মূল জায়গা এখন গাজীপুর-টাঙ্গাইল অংশ। চন্দ্রা থেকে ভোগরা পর্যন্ত ১৫ দিন ধরে যানজট হচ্ছে। মহাসড়কের এই অংশে চলছে চার লেনের কাজ। স্থানে স্থানে সড়কের দুই পাশের মাটি সরিয়ে নেওয়া, মাটির স্তূপ, নির্মাণসামগ্রী ও যন্ত্রপাতির কারণে সড়ক সংকুচিত হয়েছে। আছে খানাখন্দও। ফলে এখনই এই পথে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা জটে আটকে থাকতে হচ্ছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও পরিবহন চালকেরা জানিয়েছেন। এই পথ দিয়ে উত্তরবঙ্গ ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ১৬ জেলার যানবাহন চলে।

গাউছিয়া পাইকারি কাপড়ের বাজারের কারণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের ভুলতা অংশ সব সময়ই যানজট-প্রবণ। গত বছরের শেষের দিকে সেখানে উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ, খানাখন্দ ও সড়ক সংকুচিত হওয়ায় যাত্রীদের দুই-তিন ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে। জায়গাটি ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-বাইপাস জাতীয় মহাসড়ক এবং ভুলতা-আড়াইহাজার ও ভুলতা-রূপগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের সংযোগস্থল। বৃহত্তর সিলেটসহ আট জেলার মানুষের সড়কপথে যাতায়াতের একমাত্র পথ এটি।

এবার পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় ঘরমুখী মানুষের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে ২ জুন রাজধানীর রমনা রেস্তোরাঁয় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়। সভায় হাইওয়ে পুলিশ ভুলতা উড়ালসড়ক ও গাজীপুর-টাঙ্গাইল অংশের মহাসড়কে ভোগান্তির আশঙ্কা প্রকাশ করে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেন করার কাজ এখনো পুরো শেষ হয়নি।

সড়কের অবস্থা ও ঈদ প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে অবস্থা, আশা করি, এবার সড়কের দুরবস্থার কারণে ঈদ মাটি হবে না। তবে অতি বর্ষা যদি অব্যাহত থাকে, কিছুটা সমস্যা হতে পারে।’ গাজীপুর-টাঙ্গাইল ও ভুলতা উড়ালসড়ক এলাকার যানজটের বিষয়ে তিনি বলেন, এই জায়গাগুলোতে সড়ক সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তবে নির্মাণকালীন কিছু ভোগান্তি আছে। ঈদে এই দুটি স্থানসহ যানজট-প্রবণ এলাকাগুলোতে এক হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেওয়া হবে।

সওজের আওতাধীন গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক ও সড়কের অবস্থা প্রতিবছরই সমীক্ষা করে সংস্থাটির মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগ (এইচডিএম)। গত মার্চে প্রকাশিত এইচডিএমের সর্বশেষ সমীক্ষায় দেখা গেছে, জাতীয় মহাসড়কের ২৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ ভালো। ৪৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ সড়ক চলনসই। খারাপ সড়কের পরিমাণ ২২ দশমিক ৯১ শতাংশ। বেহাল সড়ক ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা ১৩৪ কিলোমিটার। খুবই বেহাল সড়কের পরিমাণ ২ দশমিক ২১ শতাংশ বা প্রায় ৮৭ কিলোমিটার।

এই সমীক্ষা ধরে জাতীয় মহাসড়ককে দুই ভাগে ভাগ করলে দেখা যায়, দেশের ৩ হাজার ৭৫৯ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কের ৭১ দশমিক ৩১ শতাংশ ভালো ও চলনসই। বাকি প্রায় ২৯ শতাংশ মহাসড়ক খারাপ ও বেহাল।

জাতীয় মহাসড়কের বাইরে সওজের অধীন পিচঢালা আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক আছে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কিলোমিটার। জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক—এই তিন শ্রেণির সড়কের মধ্যে ভালো ও চলনসই ৫৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। বাকি ৪৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ সড়ক খারাপ, বেহাল ও খুব বেহাল।

এর বাইরে বেশির ভাগ গ্রামীণ সড়ক স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীন। সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকার সড়কের মালিক সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা।

সওজের কর্মকর্তারা বলেন, এইচডিএমের সমীক্ষা তৈরি করা হয়েছে গত বছর শুকনো মৌসুমে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে। প্রতিবছর বর্ষাকালে বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের নতুন নতুন স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ বিষয়ে সচিব এম এ এন সিদ্দিক বলেন, এইচডিএম সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছর তাঁরা টাকা বরাদ্দ করেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। এবারও সব সড়কেই বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

গাজীপুর-টাঙ্গাইল অংশে জট: একাধিক পরিবহন মালিক ও শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৫ দিন ধরে যানজটের কারণে গাজীপুর-টাঙ্গাইল অংশ পার হতে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা বাড়তি লাগছে। মহাখালী-রংপুর পথে চলাচলকারী এনা পরিবহনের চালক রিপন মিয়া গতকাল প্রথম আলোকেবলেন, ভাঙাচোরা সড়ক, নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ, কম গতির ও লোকাল গাড়ির আধিক্যে আট ঘণ্টার যাত্রা ১৩-১৪ ঘণ্টা লাগছে।

ঢাকা-টাঙ্গাইল পথের নিরালা পরিবহনের চালক স্বপন বলেন, টাঙ্গাইল যেতে তিন ঘণ্টা লাগত। কিন্তু এখন লাগে ছয়-সাত ঘণ্টা। ঢাকা-বগুড়া পথের শাহ ফতেহ আলী পরিবহনের পিন্টু মোল্লা বলেন, আসলে রাস্তা ঠিক করার পর বেশি দিন ভালো থাকে না।

প্রথম আলোগাজীপুর প্রতিনিধি জানান, মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক করতে গাজীপুর পুলিশ কিছু কমিউনিটি পুলিশ নিয়োগ করেছে। কিছু স্থানে মহাসড়কের দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। মহাসড়কের কোথাও চলছে খোঁড়াখুঁড়ি, কোথাও চলছে মেরামত।

চার লেন প্রকল্পের চন্দ্রা থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত অংশের প্রকৌশলী আবদুর রাজ্জাক বলেন, সাময়িক অসুবিধা হচ্ছে। তবে ঈদের ছুটির আগেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

চার লেনের পুরো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না: ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক গত মে মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার কথা ছিল। তবে সওজ সূত্র বলছে, পুরোপুরি চালু হতে আরও দু-এক মাস লাগবে। এখন মহাসড়কের বেশির ভাগ অংশে আগের সড়ক ও নতুন সড়ক দুটিই ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু কিছু স্থানে নির্মাণসামগ্রী, যন্ত্রপাতি ও স্তূপ রেখে সড়ক আটকে দেওয়ায় দ্রুত চলা যানগুলো হঠাৎ করে আটকে যাচ্ছে। এ জন্য চার লেনের পুরো সুবিধা পাচ্ছেন না যাতায়াতকারীরা।

প্রকল্পের পরিচালক আফতাব হোসেন খান বলেন, এখন টুকটাক মেরামত, সৌন্দর্যবর্ধন, মহাসড়কে সাইন-সিগন্যালের কাজ বাকি আছে। ঈদের সময় পুরো চার লেন যাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যবহার করা যায়, সে জন্য কাজ বন্ধ রাখা হবে।

জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত প্রায় ৭৬ কিলোমিটার চার লেনে উন্নীত হয়েছে গত বছর। যান চলাচলও করছে। কিন্তু ভালুকা অংশে ১১ কিলোমিটার সময়মতো শেষ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেড। সরকার পরে সেনাবাহিনীকে এই কাজ দেয়। আরও কিছু স্থানে সাইন-সিগন্যাল ও সড়ক বিভাজকের কাজ বাকি। ফলে এখানেও পুরো চার লেনের সুফল মিলছে না।