পাঁচ জেলায় আরও ৩৬ 'নিখোঁজের' খোঁজ মিলেছে

র‌্যাবের তালিকাভুক্ত ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের মধ্যে গতকাল শুক্রবার ঢাকাসহ পাঁচ জেলায় আরও ৩৬ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। এর আগের দুদিনে ৬০ জনের সন্ধান পাওয়া যায়। এ নিয়ে মোট ৯৬ জনের খোঁজ পেয়েছেন প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা, যাঁরা এখন বাড়িতে থেকেও নিখোঁজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
গত মঙ্গলবার রাতে র‌্যাব নিখোঁজ ২৬২ জনের নাম প্রকাশ করে। এই তালিকায় চট্টগ্রামের নিখোঁজ ৩৪ জনের নাম রয়েছে। এঁদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৩০ জনের ঠিকানায় গিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা অনুসন্ধান করে ২৩ জনের খোঁজ পেয়েছেন। যাঁরা বাসায় ফিরে এসেছেন।
এঁদের মধ্যে পাহাড়তলীর মো. রিয়াজ পরিবারের অমতে বিয়ে করে গত ৪ জুন বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। তিন সপ্তাহ পর ফিরে আসেন বলে জানিয়েছেন তাঁর মা জোসনা আক্তার। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রণজিৎ বড়ুয়াও।
পাহাড়তলীর জাহের সুপার মার্কেটের হক বিরিয়ানি হাউসের কর্মচারী এনামুল হক ৩ জানুয়ারি নিখোঁজ হন বলে থানায় জিডি হয়েছিল। বৃহস্পতিবার এলাকায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তিনি কুষ্টিয়া ছিলেন, পরে বাড়ি ফিরেছেন।
নাসিরাবাদের মোহাম্মদ শাহজালাল শামীম গত ২৬ জানুয়ারি নিখোঁজ হন। তিন দিন পর তাঁকে ষোলশহর রেললাইনের ওপর পাওয়া যায়। তাঁর ভাগনে আরিফুর রহমান বলেন, ‘মামা মানসিক রোগী। তাঁকে এখন নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে রাখা হয়েছে।’
র‌্যাবের তালিকায় ‘নিখোঁজ’ আবদুর রহিমের সঙ্গে গতকাল কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, ‘আমি অ্যাম্বুলেন্সচালক। চকবাজারের চট্টেশ্বরী এলাকার বাসা থেকে ৩০ মে বেরোনোর পর মুঠোফোনে চার্জ ছিল না। বাসায় কেউ যোগাযোগ করতে না পেরে জিডি করেছিল।’
‘নিখোঁজ’ আজিউর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ৩০ মার্চ আমি একা একা ঢাকায় চলে যাই। এ কারণে পরিবার জিডি করেছিল। তিন দিন পর আমি বাড়িতে ফিরে আসি।’
সদরঘাট এলাকার মানিক হোসেন, মো. সবুজ, মো. জুয়েল ও আজিজুর রহমান ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে নিখোঁজ হন। এসব ঘটনায় পৃথক জিডি হয়। এঁদের মধ্যে মানিক একটি মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। বাকি তিনজন বাড়ি ফিরে এসেছেন। একইভাবে ডবলমুরিং থানার মোজাফফর হোসেন পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন।
পতেঙ্গার বাসিন্দা জানে আলম ও পাহাড়তলীর নুরুল হুদাকেও তাঁদের বাসায় পাওয়া গেছে। উত্তর কাট্টলীর ওমর ফারুক, হাসান কাউসার ও মো. মিলাদ যথাক্রমে ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৪ জানুয়ারি ও ১৭ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ হন। পরে তিনজনই বাসায় ফিরেছেন বলে তাঁদের পরিবার ও পুলিশ নিশ্চিত করেছে।
পূর্ব ফিরোজ শাহ এলাকার আসিফ ইকবাল ১২ মার্চ নিখোঁজ হন বলে ছোট ভাই শাহবাজ খান থানায় জিডি করেন। গতকাল শাহবাজ প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই আসিফ ফিরে এসেছেন। তিনি এখন শ্বশুরবাড়িতে থাকেন।
ইমরান হোসেন প্রেমঘটিত কারণে বাড়ি ছেড়েছিলেন, পরে ফিরে এসেছেন বলে জানিয়েছেন আকবর শাহ থানার উপপরিদর্শক আশফাক রাগিব হাসান।
আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকার সুজনকে গতকাল বিকেলে বাসায় পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। ১১ দিন পর বাসায় ফিরে আসি।’
‘নিখোঁজ’ মো. আবু সালেহ রাসেলকেও গতকাল সকালে আগ্রাবাদের বাসায় পাওয়া যায়। রাসেলের বাবা ছালাম শেখ বলেন, ‘গত ১১ জুন এক আত্মীয়কে রক্ত দিতে হাসপাতালে যাওয়ার পথে পুলিশ রাসেলকে আটক করেছিল। খোঁজ না পেয়ে তাঁর মা থানায় জিডি করেছিল।’
পরিবারের সঙ্গে রাগ করে গত ১৬ জুন ঘর ছেড়ে চলে যান হামজারবাগ এলাকার আবু তাহের (পলাশ)। ১০ জুলাই পলাশ বাড়ি ফেরেন। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর মুরাদপুরের বাসা থেকে বেরিয়ে যান নির্মাণশ্রমিক মো. মামুন। তাঁর বাবা মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ঝগড়া করে মামুন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। সে এখন বউয়ের সঙ্গে আলাদা বাসায় থাকে।’
ফটিকছড়ির নিখোঁজ শাহজাহানের স্ত্রী রোজি আক্তার বলেন, ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যা করবেন বলে তাঁর স্বামী গত ৭ মে বাড়ি ছাড়েন। এরপর আর খোঁজ নেই। গহিরার ‘নিখোঁজ’ আসিফউদদোল্যা নামের কাউকে পাওয়া যায়নি বলে জানান রাউজান থানার ওসি কেফায়েত উল্লাহ।
অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতির ছেলে আসিফ আদনানের অবস্থান সম্পর্কে চন্দনাইশ থানা-পুলিশ কিছু বলতে পারেনি। তবে আসিফ ২০১৪ সালে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ঢাকায় গ্রেপ্তার হন। তাঁর পরিবারও ঢাকায় থাকে। তিনি জামিনে বেরিয়েছেন কি না, তা চট্টগ্রামের পুলিশ জানে না।
ঢাকা: র‌্যাবের নিখোঁজের তালিকায় ঢাকার ৭৮ জনের নাম রয়েছে। এঁদের মধ্যে গতকাল আরও নয়জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। এর আগে বৃহস্পতিবার তিনজন এবং বুধবার চারজনের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। সব মিলে গতকাল পর্যন্ত ঢাকার ‘নিখোঁজ’ হওয়া মোট ১৬ জনের খোঁজ পাওয়া গেল।
র‌্যাবের তালিকায় ঢাকার তেজগাঁও থানার অধীনে ১১ জনের নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরির (জিডি) কথা উল্লেখ আছে। এঁদের নয়জনই নিখোঁজ হওয়ার পর বিভিন্ন সময় বাড়ি ফিরে এসেছেন বলে জানিয়েছেন তেজগাঁও থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এঁদের মধ্যে কেউ প্রেম করে পালিয়েছিলেন, আবার কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিলেন। পরে তাঁরা ফিরে এসেছেন।
ওসি মাজহারুল বলেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে জিডি হওয়া দুজন এখনো ফেরেননি। তাঁরা হলেন মো. রাকিবুল ইসলাম ও মো. জুবায়ের হোসেন ফারুক। জুবায়েরের স্ত্রী থানায় জিডি করেছিলেন। তিনি পুলিশকে বলেছেন, জুবায়ের মালয়েশিয়ায় আছেন, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তবে রাকিবুল জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকতে পারেন বলে তাঁর ভাই রিয়াজুল পুলিশকে জানিয়েছেন বলে ওসি জানান।
নিখোঁজের তালিকায় রয়েছেন যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে বোমা পেতে রাখার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত রাজীব করিমের ভাই তেহজীব করিম। ব্যাংকক থেকে গত ১৭ মে ঢাকায় নামার পর হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ভেতর থেকে তিনি নিখোঁজ হন বলে তাঁর পরিবার জানিয়েছে।
গতকাল তেহজীবের বাসায় তাঁর বাবা মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল করিমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তেহজীব থাইল্যান্ডে ইংরেজি শিক্ষা-বিষয়ক একটি পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন। তিনি রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ১৭ মে বিকেল পাঁচটায় ঢাকায় আসেন। ৫টা ৩০ মিনিটে গাড়িচালককে ফোন দিয়ে বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর ফটকে যেতে বলেন। কিন্তু গাড়িচালক সেখানে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও তেহজীবকে বের হতে দেখেননি। এরপর ওই দিনই তাঁরা বিমানবন্দর থানায় গিয়ে জিডি করতে চাইলে পুলিশ জিডি নেয়নি। পরদিন আবার বিমানবন্দর থানায় গেলে পুলিশ জিডি নেয়।
জয়নুল করিমের দাবি, তেহজীবের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো থানায় কোনো মামলা নেই। তাঁকে কে বা কারা কেন ধরে নিয়ে গেছে, সে বিষয়ে তাঁর কোনো ধারণা নেই।
নিখোঁজ পাইলট: গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে ঢাকার আদাবরের বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন পাইলট মো. মাহমুদুল আহসান (রাতুল)। ওই দিন রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে মুঠোফোনে মায়ের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়। জানিয়েছিলেন ফিরতে একটু দেরি হবে। এরপর এক বছর পেরিয়ে গেলেও আর ফেরেননি মাহমুদুল।
ছেলের নিখোঁজের বিষয়ে ২১ জুলাই আদাবর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন বাবা মো. রওশন আলী খান। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মাহমুদুল আহসান ২০১৫ সালে বৈমানিকের সনদ পাওয়ার পর চাকরির খোঁজে ছিলেন। ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর তিনি পুলিশ ও র‌্যাবকে জানান। পুলিশ একদিন ট্রেনে কাটা একটি শরীরের কয়েকটি অংশের ছবি ও কাপড় এনে দেখিয়েছিল। কিন্তু ওই কাপড় মাহমুদুলের ছিল না। আদালতের অনুমতি নিয়ে ওই দিন ট্রেনে কাটা পড়া লাশগুলোর ডিএনএ পরীক্ষারও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ওই তারিখে ট্রেনে কাটা পড়া সাতটি লাশ দাফন করা হয়। কিন্তু কোনটি মাহমুদুলের, তা পুলিশ নির্ধারণ করতে না পারায় ডিএনএ পরীক্ষা আর করা সম্ভব হয়নি।
রওশন আলী বলেন, ‘এক বছর হয়ে গেল। আমি এখনো জানি না আমার ছেলেটার আসলে কী হয়েছে। পুলিশ বলছে সে আত্মহত্যা করেছে বা ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কিন্তু সেটার পক্ষেও প্রমাণ পাচ্ছি না।’
সাতক্ষীরা: রযান বের তালিকায় সাতক্ষীরার দুজনের নাম আছে। এঁদের একজন তালা উপজেলার মো. রাশেদ গাজী (২৩)। তাঁর বাবা আব্বাস গাজী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রাশেদকে র‌্যাব ১৪ জুলাই ঢাকায় গ্রেপ্তার করে। এখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।
দেবহাটা উপজেলার উত্তর পারুলিয়া গ্রামের রওশন আলী কাজীর নাম আছে নিখোঁজের তালিকায়। দেবহাটা থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পুলিশ খোঁজ করে এ নামের কারও সন্ধান পায়নি। পারুলিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য সালাউদ্দিন শারাফি বলেন, ওই গ্রামে রওশন আলী কাজী নামে কেউ নেই।
নীলফামারী: নীলফামারীর ‘নিখোঁজ’ তিনজনের মধ্যে মো. আবদুল্লাহকে গতকাল সৈয়দপুরের রসুলপুর কলোনিতে তাঁর বাসায় পাওয়া গেছে। আবদুল্লাহ সৈয়দপুরের মাড়োয়ারিপট্টিতে একটি সিমেন্টের দোকানে কাজ করেন।
সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জের তিনজনের মধ্যে দুজনের খোঁজ মিলেছে। তাঁদের মধ্যে হাবিবুর রহমান পরিবারের অমতে বিয়ে করে পালিয়ে যান। এক মাস পর বাড়িতে ফিরে আসেন।
কাজীপুর উপজেলার মো. মঞ্জু (৩০) এখন ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে রিকশা চালান বলে জানিয়েছেন কাজীপুর থানার ওসি সমিত কুমার কুন্ডু।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন চট্টগ্রামের একরামুল হক, মাসুদ মিলাদ, গাজী ফিরোজ, সাঈদা ইসলাম, সুজন ঘোষ, সৌরভ দাশ, জুয়েল শীল, আবদুর রাজ্জাক ও এস এম আক্কাছ উদ্দিন; সাতক্ষীরার কল্যাণ ব্যানার্জি, সিরাজগঞ্জের এনামুল হক, নীলফামারীর সৈয়দপুরের এম আর আলম)

র‌্যাব নিখোঁজ ২৬২ জনের নাম প্রকাশ করে

*এ পর্যন্ত ৯৬ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে
*চট্টগ্রামের ৩৪ জনের ২৩ জন বাড়িতে
*ঢাকায় একজন বিমানবন্দর থেকে নিরুদ্দেশ