'খড়ি কুড়াচ্ছি, বেচি চাউল কিনমো'

মাঠ–ময়দান তলিয়ে গেছে। চারদিকে থই থই পানি​। এরই মধ্যে ভেলা নিয়ে গন্তব্যে ছুটছে এক শিশু। ছবিটি গতকাল কুড়িগ্রামের ব্যাপারির চর থেকে তুলেছেন মঈনুল ইসলাম
মাঠ–ময়দান তলিয়ে গেছে। চারদিকে থই থই পানি​। এরই মধ্যে ভেলা নিয়ে গন্তব্যে ছুটছে এক শিশু। ছবিটি গতকাল কুড়িগ্রামের ব্যাপারির চর থেকে তুলেছেন মঈনুল ইসলাম

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নের পুরোটাই বন্যাকবলিত। গতকাল সোমবার সেখানে গেলে মানুষের চরম দুর্দশার চিত্র চোখে পড়ে।
দুর্গম এই চর এলাকায় যাওয়ার দুটি সড়ক ছিল। একটি পাশের ভিতরবন্ধ ইউনিয়ন ও অপরটি কালীগঞ্জ ইউনিয়ন থেকে। দুটি সড়কই এখন পানির নিচে। ভিতরবন্ধ বাজার থেকে নৌকায় করে নুনখাওয়া ইউনিয়নে ঢুকতেই চোখে পড়ে, গ্রামগুলোতে থই থই পানি। ইউনিয়নের পূর্ব পাশে দুধকুমার, শংকোশ ও গঙ্গাধর নদ। তিন নদের মিলিত স্রোতোধারায় পুরো ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে।
নুনখাওয়া বাজারের স্কুলশিক্ষক আবু তাহের জানান, কয়েক দিন আগে প্রচণ্ড স্রোতের কারণে এলাকার একটি বাঁধের অংশবিশেষ ভেঙে যায়। সেই ভাঙা অংশ দিয়ে বাজারের পশ্চিম পাশের সব এলাকায় পানি ঢোকে।
নুনখাওয়া বাজারের পানি নেমে গেছে। বাজারের পাশের সেতুটি পানির মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সেতুর দুই পাশে কোনো সড়কের অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। সেতুর ওপরে আশ্রয় নিয়েছে বন্যাকবলিত কয়েকটি পরিবার ও তাদের গবাদিপশু।
নুনখাওয়া বাজারে কথা হয় ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ গ্রামের হযরত আলীর সঙ্গে। তাঁর বাড়িতে পানি উঠেছে। ছেলে সর্দিজ্বরে পড়লেও এলাকায় কোনো চিকিৎসক নেই। ছেলে আবদুল খালেককে (৭) নুনখাওয়া বাজারে এনে গ্রাম্য চিকিৎসককে দেখিয়ে ওষুধ কেনেন তিনি। হযরত আলী বলেন, ‘ছাওয়াটার সাত দিন থাকি জ্বর। পানির মধ্যে ডাক্তার দেখপার পাই নাই। ছাওয়া কাহিল হয়া পড়ছে। বাধ্য হয়া নিয়া আসলাম।’
নুনখাওয়া বাজার থেকে নৌকায় চর কাফনায় গিয়ে দেখা যায়, স্রোতে ভেসে আসা খড়কুটো কুড়াচ্ছেন দিনমজুর সামছুল হক ও তাঁর স্ত্রী আঞ্জুনা বেগম। একটি পাটখেতের পাশে খড়কুটো কুড়াতে কুড়াতে সামছুল হক বলেন, ‘কী করমো বাবা। ১৫ দিন থাকি পানির মদ্যি আছি। খাবার যা আছিল সউগ শ্যাষ। বাধ্য হয়া খড়ি কুড়াচ্ছি। শুকি বাজারোত বেচি চাউল কিনমো।’ তিনি জানান, এখন পর্যন্ত কেউ ত্রাণ নিয়ে তাঁদের কাছে আসেনি।
চর বার-বিশে গিয়ে দেখা যায়, সকিনা বেগম নামের এক নারী সাঁতরে বাড়িতে যাচ্ছেন। স্রোতে ভেসে যাওয়ার উপক্রম হলে তাঁকে নৌকায় তুলে নেন এই প্রতিবেদক। এ সময় সকিনা বলেন, ‘সাত দিন আগে বাড়ির টুই পর্যন্ত পানি ওঠে। খুব স্রোতে থাকা যায় না। বাধ্য হয়া দূরত যায়া একটা উঁচা জায়গায় উঠি। পানি কিছুটা কমলে সাঁতরে বাড়ি দেখপার আসছিলাম।’
নাগেশ্বরী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জি আর এম মোকসেদুর রহমান বলেন, ‘উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত। আমরা পানি বিশুদ্ধকরণের বড়ি, স্যালাইন ও ছোটখাটো চিকিৎসা দিচ্ছি।’ নুনখাওয়া ইউনিয়নের বিষয়ে তিনি বলেন, অন্যান্য ইউনিয়নে তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও নুনখাওয়ায় আছে একটি। ব্যাপারির চরে অবস্থিত ওই ক্লিনিকও এখন জলাবদ্ধ। তাই মানুষকে সেবা দেওয়া যাচ্ছে না।
নুনখাওয়া ইউপি চেয়ারম্যান শাহাবুল হোসাইন বলেন, পুরো ইউনিয়ন বন্যাকবলিত। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ কেউ ত্রাণসামগ্রী দিলেও দুর্গম চর নুনখাওয়ার মানুষ কিছুই পাচ্ছে না।