তারুণ্যের সময় খেয়ে ফেলছে বিসিএস

.
.

বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে চাকরিতে যোগদানের গেজেট। ৩৪তম বিসিএসের এই প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লেগেছে তিন বছর চার মাস। এর মধ্যে আড়াই বছর সময়ই নিয়েছে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। বিসিএসের দীর্ঘসূত্রতার এটি একটি রেকর্ড।
আবার মৌখিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার প্রায় চার মাস হয়ে গেলেও এখনো ৩৫তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়নি। এমনকি প্রথমবারের ফল স্থগিত করে দুবার মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে ‘বিতর্কিত’ ২৭তম বিসিএসেও এত দীর্ঘ সময় লাগেনি। দীর্ঘসূত্রতার এই নতুন রেকর্ডে ৩৫তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলের অপেক্ষায় থাকা ছয় হাজার পরীক্ষার্থীর ক্ষোভ আর হতাশা দিনে দিনে বাড়ছে। এই বিসিএসে যথাযথভাবে মেধার মূল্যায়ন করে ফলাফল দেওয়া হবে কি না, তা নিয়েও তাদের মধ্যে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও চলছে নানা আলোচনা।
গত এক দশকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২৮ থেকে ৩২তম বিসিএসের প্রক্রিয়াগত সময় কমে এলেও ৩৩তম বিসিএস থেকে সময় আবার বাড়ছে। বর্তমানে একটি বিসিএসের প্রক্রিয়া শেষ করতে দুই থেকে তিন বছরও লেগে যাচ্ছে। ফলে ২৪ বা ২৫ বছর বয়সে লেখাপড়া শেষ করা একজন তরুণের জীবনের বড় সময়ই চলে যাচ্ছে বিসিএস পরীক্ষায়। প্রতি বিসিএসে দুই লাখেরও বেশি শিক্ষিত তরুণ অংশ নেন। ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁরা এই পরীক্ষা দেন। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার মিলিয়ে তাঁদের মধ্যে চাকরি পান তিন থেকে চার হাজার।
৩৫তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফলের অপেক্ষা করছেন এমন শতাধিক প্রার্থী গত কয়েক দিনে প্রথম আলোকে তাঁদের ক্ষোভ আর হতাশার কথা জানিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পাস করা এক নারী প্রার্থী বলেন, ‘পিএসসি আর কচ্ছপের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে তাতে কচ্ছপ জয়ী হবে। এভাবে আমাদের কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না।’ একজন প্রার্থী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিলম্বে ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো সেঞ্চুরি করার জন্য মহান পিএসসি আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন।’ অরেকজন লিখেছেন, ‘পিএসসি তুমি প্রমাণ করলে আমরা রের্কড ভাঙার সমাজে বাস করি।’
৩৫তম ছাড়াও ৩৬ ও ৩৭তম বিসিএসের প্রক্রিয়াও চলছে। এর মধ্যে প্রিলিমিনারির ফল প্রকাশের ছয় মাস পেরোলেও ৩৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শুরু হয়নি। ১ সেপ্টেম্বর থেকে অনুষ্ঠেয় এই পরীক্ষায় অংশ নেবেন প্রায় ১৪ হাজার পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে ৩৫তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলের জন্য অপেক্ষা করছেন এমন কয়েক হাজারও আছেন। তাঁদের কয়েকজন প্রথম আলোকে বলেন, ৩৫-এর ফল প্রকাশিত না হওয়ায় যথাযথভাবে ৩৬-এর প্রস্তুতি নিতে পারছেন না।
অন্যদিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও ৩৭তম বিসিএসের প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষার তারিখই ঠিক করতে পারেনি পিএসসি। এই পরীক্ষায় আবেদন করা দুই লাখ পরীক্ষার্থী এখন সেই তারিখের অপেক্ষা করছেন।
৩৫ বিসিএসের চূড়ান্ত ফল দিতে দেরি হওয়ায় পরীক্ষার্থীদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতেই ফলাফলে দেরি হচ্ছে? তবে পিএসসির কর্মকর্তারা বলছেন, সাবেক চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ এ বছরের ১৩ এপ্রিল অবসরে যান। এরপর ২ মে চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ সাদিক। এখন তাঁর নেতৃত্বে ফল তৈরির কাজ চলছে।
বিসিএসের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে জানতে চাইলে পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক গতকাল বলেন, দেখে মনে হয় বিসিএস শুধু ২৭টি ক্যাডারে নিয়োগ পরীক্ষা। আসলে শুধু শিক্ষা ক্যাডারেই ৭৯ রকমের প্রশ্ন করতে হয়। এসব পরীক্ষার খাতা নিরীক্ষণে সময় লাগে। ক্যাডার ছাড়াও নন-ক্যাডারের অনেক পরীক্ষা নিতে হয়। এখন প্রতিদিন ৪০০ নার্স নিয়োগের সাক্ষাৎকার নিতে হচ্ছে। এসব কারণে দেরি হচ্ছে।
পিএসসির চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘৩৪তম বিসিএসের নন-ক্যাডারের দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। আমরা আশা করছি এ মাসের মাঝামাঝি সেটা শেষ করতে পারব। এরপরই ৩৫ বিসিএসের ফল দেওয়া হবে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৩৬ বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শুরু হবে। আর আমরা খুব শিগগিরই ৩৭-এর প্রিলিমিনারির তারিখ দিয়ে দেব। আশা করছি, সেপ্টেম্বরের শেষেই সেটা হবে।’
দীর্ঘসূত্রতার রেকর্ড, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ: ২০০৩ সালের ২৪তম বিসিএস থেকে শুরু করে গত এক যুগের ১২টি বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি, লিখিত ও চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফলের সময়সূচি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২৭তম বিসিএসে প্রায় তিন বছর সময় লেগেছে। জরুরি অবস্থা চলাকালে আগের ফল বাতিল করে দ্বিতীয়বার মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। এ ছাড়া নতুন করে পিএসসি চেয়ারম্যান নিয়োগ ও কমিশন গঠন করা হয়। তবে ২৮তম বিসিএসে সেই সময় কমে দুই বছর পাঁচ মাসে নেমে আসে।
২৯তম বিসিএসে সময় লাগে দুই বছর এক মাস। ৩০তম বিসিএসের বিজ্ঞাপন থেকে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করতে এক বছর আট মাস সময় লাগে। ৩১তম বিসিএসে দেড় বছর, ৩২তম বিশেষ বিসিএসে এক বছর এক মাস সময় লাগে। অবশ্য গেজেট প্রকাশের তারিখ ধরলে ২৮তম বিসিএসে ৩১ মাস, ২৯তম বিসিএসে ৩০ মাস, ৩০তম বিসিএসে ২৬ মাস, ৩১তম বিসিএসে ২৩ মাস ও ৩২তম বিসিএসে ১৪ মাস লেগেছে। কিন্তু ৩৩তম বিসিএস থেকেই দীর্ঘসূত্রতা বাড়তে থাকে।
৩৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল ২০১২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। এই বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন ১৮ হাজার ৬৯৩ জন। মৌখিক পরীক্ষার ৭২ দিন পর ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। সব মিলিয়ে এই বিসিএসের জন্য পিএসসি সময় নেয় এক বছর নয় মাস। তবে গেজেট প্রকাশ করা হয় আরও আট মাস পর ২০১৪ সালের ১৯ জুলাই। প্রার্থীরা চাকরিতে যোগ দেন ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট। সব মিলিয়ে সময় লাগে দুই বছর পাঁচ মাস।
তবে দীর্ঘসূত্রতার সব রেকর্ড ভেঙেছে ৩৪তম বিসিএস। ২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এর প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। চূড়ান্ত ফল হয় ২০১৫ সালের ২৯ আগস্ট। অর্থাৎ আড়াই বছর সময় লাগে। নয় মাস পর ২০১৬ সালের ১৬ মে গেজেট প্রকাশ করা হয়। উত্তীর্ণ ২ হাজার প্রার্থী ১ জুন চাকরিতে যোগ দেন। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তি থেকে চাকরিতে যোগদানে সব মিলিয়ে লেগেছে প্রায় ৪০ মাস।
অবশ্য প্রিলিমিনারির ফল প্রকাশ থেকেই ৩৪তম বিসিএস নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। এরপর মামলা, কোটা আর মেধা আলাদা না করে চূড়ান্ত ফল, নিয়োগে অস্বচ্ছতাসহ নানা কারণে এই বিসিএস নিয়ে এখনো বিতর্ক শেষ হয়নি।
৩৪তম বিসিএসেরও রেকর্ড ভেঙেছে ৩৫। এ বছরের ১২ এপ্রিল মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়। আজ ৭ আগস্ট পর্যন্ত ১১৫ দিনেও চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়নি। অথচ এর আগে ২৯ বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষার পর চূড়ান্ত ফল প্রকাশে ৮৯ দিন, ৩০তম বিসিএসে ৪১ দিন, ৩২তম বিসিএসে ৪২ দিন, ৩৩তম বিসিএসে ৭২ দিন সময় লাগে।
বিসিএস পরীক্ষায় কেন এত সময় লাগে জানতে চাইলে পিএসসির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো খাতা দেখার কাজটি ম্যানুয়ালি হয়। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো একজন পরীক্ষক হয়তো দেরি করে খাতা পাঠালেন। আবার দেখা যায় নম্বরের যোগে ভুল হয়েছে। এসব কারণে সময় বেশি লাগে। আবার বিসিএসে কোটা পদ্ধতি আছে। দেখা যায়, কোটা নির্ধারণে একটা ভুল হলে পুরো ফলই আবার তৈরি করতে হয়। এসব কারণে দেরি হয়ে যায়। আবার পিএসসি চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে দিলেও পুলিশি যাচাইয়ের কারণে তাঁদের চাকরিতে যোগ দিতে আরও সময় লেগে যায়। তবে সময় কমিয়ে আনা জরুরি।’
জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারুণ্য একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষিত মেধাবী তরুণ-তরুণীদের জীবনের একটা বড় অংশই চলে যাচ্ছে বিসিএস পরীক্ষা দিতে। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। একটা বিসিএসের জন্য সময় কোনোভাবেই এক বছরের বেশি লাগা উচিত নয়। ভারত, পাকিস্তান কোথাও এত সময় লাগে না।’