জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের তদন্তে সমন্বয়হীনতা!

গুলশান হামলার পর জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রম জোরদার হলেও সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। জঙ্গি মামলার তদন্ত, নিখোঁজ সন্দেহভাজনদের খুঁজে বের করা, অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য আদান-প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা প্রকাশ্য হচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।

পুলিশ ও র‍্যাবের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিভিন্ন বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মিলেমিশে জঙ্গিবাদ নির্মূল কার্যক্রমকে জোরালো করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। নিয়মিতভাবে সমন্বয় করে তাঁদের কাজ করতে বলা হয়। এরপর কিছুদিন সমন্বিত কার্যক্রম চললেও এখন আবার সম্পর্কগুলো কিছুটা পুরোনো অবস্থায় ফিরেছে। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে নানা বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে কর্মকৌশল নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে মতভিন্নতা প্রকাশ পেয়েছে।

বিশেষ করে গুলশান হামলার জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার পাওয়া এবং পরে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়া হাসনাত করিম ও তাহমিদ হাসিব খানের ঘটনার সঙ্গে যুক্ততা নিয়ে সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের মতভিন্নতা প্রকাশ্য হয়েছে। জিম্মিদশা থেকে মুক্তির পরে গত ২ জুলাই হাসনাত ও তাহমিদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ। কিন্তু ৬ জুলাই কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের কাস্টডিতে কেউ নেই। চারজনকে সন্দেহ করা হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে দুজন রেস্তোরাঁর কর্মী ও দুজন জিম্মিদশা থেকে বেঁচে ফিরেছেন।’

মূলত এরপর থেকেই শুরু হয় হাসনাত ও তাহমিদের নিখোঁজ থাকার পর্ব। শেষে ৪ আগস্ট ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার রাস্তা থেকে এই দুজনকে সন্দেহজনক আচরণের অভিযোগে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। ৫৪ ধারার আওতাতেই তাঁদের আট দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ড শেষে ১৩ আগস্ট হাসনাতকে গুলশান হামলার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আবারও আট দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। তার আগ পর্যন্ত কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা গুলশান হামলার সঙ্গে হাসনাত ও তাহমিদের যুক্ততার বিষয়ে কিছু বলেননি।

গুলশান হামলার ঘটনার তিনটি ছবি ৭ ও ৮ আগস্ট বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ছবিগুলোতে গুলশানে রেস্তোরাঁয় জিম্মি সংকটের সময় হাসনাত ও তাহমিদকে এক জঙ্গির সঙ্গে কথা বলতে বা সলাপরামর্শ করতে দেখা যায়। এ সময় তাহমিদের হাতে অস্ত্র ছিল। কয়েকটি গণমাধ্যমে ওই ছবি প্রকাশ করে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের বেনামি বরাত দিয়ে দাবি করা হয়, ঘটনার সঙ্গে তাহমিদ ও হাসনাতের যুক্ত থাকার বিষয়ে নানা তথ্য-প্রমাণ কর্মকর্তাদের হাতে এসেছে। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও ৭ আগস্ট বলেন, ‘মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ার পরই হাসনাত রেজা করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ শেষ পর্যন্ত গত শনিবার হাসনাতকে গুলশান হামলার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

তবে ৭ আগস্ট কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘কী পরিস্থিতিতে হাসনাত করিম ও তাহমিদ হাসিব খানের হাতে অস্ত্র ছিল, কী পরিস্থিতিতে তাঁদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এমন হয়েছে, এটা বিশ্লেষণ করে প্রাপ্ত তথ্য মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। এসবের সঙ্গে মিলিয়েই তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষ না হলে এ বিষয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ তথ্য আমরা দিতে পারছি না।’

এদিকে মহানগর পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওই ছবিগুলো যে গণমাধ্যমে সরবরাহ করা হয়েছে, তা ৬ আগস্ট রাতেই তাঁরা জেনেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে কথাও বলেছেন। তবে কোন তথ্যগুলো গণমাধ্যমে দেওয়া যাবে, এ নিয়ে তাঁরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অন্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেননি।

সরকারের অন্যান্য সংস্থার কাছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সাহায্য চেয়ে পাচ্ছে কি না, জানতে চাইলে ১২ আগস্ট মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অন্যান্য সংস্থার কাছে গুলশান হামলার বিষয়ে যে তথ্য ও ছবি আছে, তা চাওয়া হয়েছে। সংস্থাগুলো বেশ কিছু ছবিও দিয়েছে। তবে এগুলোর কোনোটাই সেই ছবিগুলোর (৭ ও ৮ আগস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত) মতো স্পষ্ট নয়।

তাহমিদ ও হাসনাতের ঘটনা ছাড়া আরও কয়েকটি ঘটনা নিয়ে বাহিনীগুলোর মধ্যে ভিন্নমত প্রকাশ্য হয়েছে। ঈদের দিনে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলার সঙ্গে জড়িত শফিউল ইসলামকে গ্রেপ্তারের কৃতিত্ব নিয়েও পুলিশ ও র‍্যাবের মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের কথা জানা যায়। র‍্যাবের দাবি, শফিউলকে তারা গ্রেপ্তার করেছে। আর কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ ও পরে ঢাকার কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাও দাবি করেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শফিউলকে ধরে ফেলে পুলিশ। পরে তাঁকে নিয়ে যান র‍্যাবের কর্মকর্তারা। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে র‍্যাবের কথিত ক্রসফায়ারে শফিউল নিহত হলে বিতর্কটা আরও বেড়ে যায়। জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী পুলিশের একজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, শফিউলকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য পুলিশকে দেয়নি র‍্যাব। পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগও দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে র‍্যাবের কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলতে চাননি। তবে র‍্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, শফিউলকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় সরকারের আটটি সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে লুকোছাপার কিছু নেই।

এ ছাড়া সন্দেহভাজন নিখোঁজদের তালিকা নিয়েও ছিল সমন্বয়হীনতা। গত ২০ জুলাই র‍্যাবের তৈরি ২৬২ জন নিখোঁজের তালিকা প্রকাশের পর থেকেই পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে দ্বিমত প্রকাশ করে আসছিলেন। তখন পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা না করেই এ তালিকা প্রকাশ করেছে র‍্যাব। তবে আনুষ্ঠানিক ফোরামে এ বিষয় নিয়ে তাঁদের আলোচনা ও তথ্য আদান-প্রদান হয়েছে বলে জানা যায়নি। শেষ পর্যন্ত ৭ আগস্ট র‍্যাব তালিকা ছোট করে ৬৮ জনে নামিয়ে আনে। পরে আরও দুজন বাড়িয়ে ৭০ করা হয়।

এ ছাড়া গুলশান হামলার মামলায় আহত র‍্যাব সদস্যদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা নিয়েও ‘মান-অভিমানের’ ঘটনা ঘটে। হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন র‍্যাব-১-এর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে তাঁর শরীর থেকে স্প্লিন্টার বের করতে হয়। কিন্তু ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারে পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত সব আহত সদস্যের নাম থাকলেও র‍্যাবের সেই কর্মকর্তার নাম নেই। বিষয়টি নিয়ে র‍্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ঘটনায় আমাদের মন খুবই খারাপ হয়েছে। আমরাও তো ঘটনার অংশ ছিলাম।’

গুলশান থানার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গুলশান থানার একজন উপপরিদর্শক বাদী হয়ে ওই থানায় মামলা দায়ের করলেও এজাহারটি তৈরি করেছেন ডিবির কয়েকজন কর্মকর্তার একটি দল। তাই এ বিষয়ে গুলশান থানার কিছু বলার নেই।

সর্বশেষ ১০ আগস্ট দুপুর ১২টায় পুলিশ সদর দপ্তরে গুলশান ও শোলাকিয়ায় নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারকে আর্থিক অনুদান দিতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানটিতে পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে নিহত চার সহকর্মীর পরিবারদের ৭০ লাখ টাকার অনুদান দেন। অনুষ্ঠানটির সংবাদ সংগ্রহের জন্য আগের দিনই গণমাধ্যমকে চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু গোল বাধে ওই দিন একই সময়ে (দুপুর ১২টায়) র‍্যাব সংবাদ সম্মেলন ডেকে বসলে। বুধবার সকালে র‍্যাবের পক্ষ থেকে খুদে বার্তা দিয়ে জানানো হয়, তারা পাঁচ সন্দেহভাজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে, এ বিষয়ে সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠানের সময় র‍্যাব সংবাদ সম্মেলন ডাকায় সংবাদমাধ্যমের কাছে বিরক্তি প্রকাশ করেন পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

এ ছাড়া গত ৬ জুলাই ভোরে র‍্যাবের একটি দল ঝিনাইদহ শহরের সোনালীপাড়ায় একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে চারজনকে আটক করে বলে এলাকাবাসী জানান। ওই আস্তানায় গুলশান হামলায় জড়িত জঙ্গি নিবরাস ইসলাম এবং শোলাকিয়ায় পুলিশের ওপর হামলায় জড়িত জঙ্গি আবির রহমানসহ আটজন একসময় ছিলেন। বাড়ির মালিকের স্ত্রী, স্থানীয় লোকজন পত্রিকায় ছবি দেখে তাঁদের শনাক্ত করেছেন। তবে ১৭ জুলাই ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, ওই জেলায় জঙ্গিদের কোনো আস্তানা নেই। শহরের সোনালীপাড়ায় একটি মেসে নিবরাস ইসলাম ও আবির রহমান অবস্থান করেছিলেন, এমন খবরও পুলিশের কাছে নেই।

বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে মতভিন্নতার বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কমোডর ইশফাক ইলাহি চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কার দায়িত্ব কী, এগুলো লিখিতভাবে ভাগ করে না দিলে অর্থাৎ একটি লিখিত কার্যপ্রণালি না থাকলে এ রকম কিছু হতে পারে। এগুলোর সমন্বয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পৃথক একটা পর্ষদ থাকলে ভালো হয়। সরকারের মধ্যে হয়তো এ রকম চিন্তাভাবনা চলছে। তাহলে সবকিছু একটা সমন্বিত ব্যবস্থার মধ্যে আসবে।