সরকার মুনাফা করলেও দাম কমাচ্ছে না

গত ৪০ বছরে জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণন খাতে সরকার যত টাকা ভর্তুকি কিংবা ঋণ হিসেবে দিয়েছে; শুল্ক, কর ও মুনাফা হিসেবে নিয়েছে তার প্রায় দ্বিগুণ। বিশ্ববাজারে দাম কম থাকায় এই খাত এখন শুল্ক ও কর ছাড়াও সরকারকে বিপুল অঙ্কের মুনাফা দিচ্ছে। তারপরও সরকার জ্বালানি তেলের দাম আপাতত আর কমাতে চাইছে না।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সূত্রে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় চার দশক আগে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) গঠিত হওয়ার পর থেকে চলতি আগস্ট মাস পর্যন্ত ৪০ বছরের মধ্যে বিপিসি লোকসান দিয়েছে ২০ বছর। আর ২০ বছর মুনাফা করেছে। এই লাভ-লোকসান সমন্বয় করার জন্য সরকার বিপিসিকে ভর্তুকি বা ঋণ হিসেবে দিয়েছে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে এই ৪০ বছরে বিপিসির কাছ থেকে শুল্ক, কর ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বাবদ সর্বমোট নিয়েছে ৭৫ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত বিপিসির যে মুনাফা হয়েছে, তার ওপর থেকে লভ্যাংশ (ডিভিডেন্ড) হিসেবে সরকার আরও নিয়েছে ১ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা।
বুয়েটের পেট্রোলিয়াম প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি খাতে সরকার এক দিক থেকে দেয়, আরেক দিক থেকে নেয়। এতে বোঝা যায় না এটা লাভজনক, না অলাভজনক। এটা নিয়ে অস্পষ্টতা থাকা উচিত নয়। সরকার যে বলে এ খাতে ঋণ দিয়েছে, ভর্তুকি নয়। কিন্তু বাজেট বরাদ্দে সব সময় এটা ভর্তুকি হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আসছে। জ্বালানি খাতে সরকার কোনো ঋণ দেয় না।
২০১৪ সালের জুন থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অব্যাহতভাবে কমতে থাকে। কিন্তু গত এপ্রিল পর্যন্ত দেশে দাম না কমানোয় বিপিসি মুনাফা করেছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল গত অর্থবছরেই বিপিসি শুল্ক, কর ও মূসক বাবদ সরকারকে ৫ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা দেওয়ায় সরকারের মুনাফা হয়েছে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা।
বিশ্ববাজারে এখন পর্যন্ত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৫০ মার্কিন ডলারের কম। জ্বালানি তেলের বাজার বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস অনুযায়ী আরও বছর তিনেক এই দাম ৩০ থেকে ৫০ ডলারের মধ্যেই থাকবে। এই পরিস্থিতি সত্ত্বেও সরকার আপাতত দেশে দাম কমাতে চাইছে না।
বিশ্ববাজারে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি না হলে দেশে ছয় মাসের মধ্যে তিন ধাপে দাম কমানো হবে বলে আভাস দিয়ে গত ২৫ এপ্রিল থেকে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমানো হয়। এরপর চার মাস অতিবাহিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় ধাপে দাম কমানোর কোনো উদ্যোগ সরকারের মধ্যে নেই। অথচ দাম কমার কারণে গত দুই মাসের মধ্যে ভারতে তিন দফায় জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছে।
গত মে-জুন থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৩০ ডলার থেকে কিছুটা বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে তা প্রায় ৫০ ডলারে উঠেছিল। এরপর আবার তা কমতে শুরু করে এবং এখন তা ৪৫ ডলারের মধ্যে আছে। তা ছাড়া প্রায় তিন বছর ধরে দেশে অকটেন ও পেট্রল আমদানি করতে হচ্ছে না। দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাসের উপজাত হিসেবে পাওয়া কনডেনসেট দিয়ে দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে চাহিদার শতভাগ অকটেন-পেট্রল। ফলে সরকারের মুনাফা হচ্ছে আরও বেশি।
এ ব্যাপারে ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের উচিৎ জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে সমন্বয় করা। এই খাত তো অলাভজনক নয়। বাজার দরের সঙ্গে সমন্বয় করলেও এটা লাভজনকই থাকবে।
বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের বিষয়ে এপ্রিলের পর আর কোনো আলোচনা হয়নি। এখন আবার আলোচনা শুরু করা হতে পারে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, আপাতত দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। গ্যাসের দাম বাড়ানোর যে প্রক্রিয়া এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) চলছে, তা শেষ হওয়ার পর এ বিষয়ে চিন্তা করা হতে পারে।
জ্বালানি তেলের দাম কমানোর বিষয়ে বহু আলাপ-আলোচনার পর গত মার্চ-এপ্রিলে সরকার তিন ধাপে জ্বালানি তেলের (অকটেন, পেট্রল ও ডিজেল) দাম লিটারপ্রতি মোট ২০ টাকার মতো কমানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে প্রথম দফায় গত ২৪ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে লিটারপ্রতি ১০ টাকা কমানো হয়; প্রকৃতপক্ষে যার কোনো সুফল সাধারণ মানুষ পায়নি। কারণ, এটুকু দাম কমানোর ফলে কোনো ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের ব্যয় সাশ্রয় হয়নি।
জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেল, ফার্নেস ও কেরোসিনের দামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষের স্বার্থ জড়িত। ডিজেল ব্যবহৃত হয় বাস-ট্রাক, লঞ্চ-স্টিমার, ট্রেন এবং কৃষিতে সেচের কাজে। কাজেই ডিজেলের দাম কমলে যানবাহনের ভাড়া ও কৃষির খরচ কমে। প্রতি লিটার ডিজেলের দাম মাত্র ৩ টাকা কমানো হলেও সেচ ও যানবাহনের ব্যয়ভার অবশ্যই কিছু কমেছে। কিন্তু তার পরিমাণ এতই কম যে যানবাহনের ভাড়া কমেনি।
আর্থিক বিবেচনায় ডিজেলের দাম যে প্রতি লিটারে ৩ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা কমানো যেত না, তা নয়। কারণ, ৩ টাকা কমানোর পরও প্রতি লিটার ডিজেলে বিপিসির মুনাফা হচ্ছে প্রায় ২৫ টাকা। সরকারি হিসাবে গত মৌসুমে সেচে ডিজেল ব্যবহৃত হয়েছে ৯ লাখ টনের বেশি। প্রতি লিটারে ৩ টাকা কমায় এই ৯ লাখ টন ডিজেলের জন্য পাম্পমালিকদের সাশ্রয় হয়েছে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। কিন্তু দাম কমানোর মাধ্যমে বিপিসি তথা সরকারের ছেড়ে দেওয়া এই অর্থের কোনো সুফল কৃষক পর্যায়ে পৌঁছেনি।
ফার্নেস তেল ব্যবহৃত হচ্ছে মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এই তেলের দাম কম থাকলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ও কম পড়ে। ফলে সেই সুবিধা বর্তমানে পায় দেশের প্রায় ৭৭ শতাংশ মানুষ। সরকার গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ফার্নেসের দাম প্রতি লিটারে ১৮ টাকা কমিয়ে ৪২ টাকা করে। কিন্তু এর দাম আরও কমানো যেত। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ফার্নেসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারদরের সমান করা উচিত, যা বর্তমানে প্রতি লিটার ৩০ টাকার মতো। তাতে বিদ্যুতের দামে স্থিতাবস্থা রাখা সম্ভব হবে।
গত এপ্রিলে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুফল সাধারণ মানুষ না পেলেও বিত্তবানেরা যথেষ্টই পেয়েছেন। মূলত ব্যক্তিগত গাড়িতে ব্যবহার্য অকটেন ও পেট্রলের দাম লিটারপ্রতি ১০ টাকা কমানোয় অকটেন ব্যবহারকারীদের সাশ্রয় হচ্ছে বছরে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। আর পেট্রল ব্যবহারকারীদের সাশ্রয় হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সরকার দাম কমানোর ফলে যাঁদের এই সাশ্রয় হচ্ছে, তাঁরা সবাই বিত্তবান কিংবা অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্ত।
কিন্তু জ্বালানির দাম কমানোর সুফল যাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া অর্থনীতিতে বৈষম্য কমানোর জন্য জরুরি, তাঁরা কোনো সুফলই পাননি। জ্বালানির দাম আরও কমানো না হলে সড়ক, নৌ, রেল পরিবহন, সেচ প্রভৃতি খাতে ব্যয় সাশ্রয়ের সুবিধা সাধারণ মানুষ পাবে না।
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, গত এপ্রিলে সরকার জ্বালানি তেলের দাম যেটুকু কমিয়েছে, তার কোনো সুফল সাধারণ মানুষ পায়নি। এর সম্পূর্ণ মুনাফা বিত্তবান ও ব্যবসায়ীদের পকেটে গেছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখনো কম। কাজেই দেশেও এর দাম আরও কমানো উচিত। কিন্তু সরকার সেই পথে তো হাঁটছেই না, বরং দেশের প্রধান বাণিজ্যিক জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও বাড়াতে চাইছে। এটা সাধারণ মানুষের জন্য তো নয়ই, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও ভালো হবে না।