এত গোলাগুলি এলাকার কেউ আগে দেখেননি

নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া বড় কবরস্থানের খাদেম মোহাম্মদ সাইদুর রহমান সকাল সাড়ে সাতটার দিকে কবরস্থানে আসার পথে পুলিশ তাঁকে আটকে দেয়। পরিচয় দেওয়ার পর পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেয়। কবরস্থানের ফটকের লাগোয়া অফিসে বসার কিছুক্ষণ পরই ঘণ্টা খানেক গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন সাইদুর রহমান।

পাইকপাড়া মহল্লার ৮ নম্বর শাহসুজা রোডের ৪১০/১ বাড়িটিতে আস্তানা গেড়েছিল জঙ্গিরা। গতকাল শনিবার ওই আস্তানা ঘিরে সকালে ঘণ্টাব্যাপী বন্দুকযুদ্ধে জঙ্গিনেতা তামিম চৌধুরীসহ তিনজন নিহত হন। ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়েবসাইট ডিএমপি নিউজের তথ্যমতে, গতকাল সকাল আনুমানিক সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত অভিযান চলে। ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকার বেশির ভাগ মানুষই জীবনে কোনো দিন এত গোলাগুলি দেখেননি বা শব্দ শোনেননি। কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ লোক গোলাগুলির আওয়াজ শুনে মুক্তিযুদ্ধের কথাই মনে করেছেন বারবার।

স্থানীয় বাসিন্দাদের বেশির ভাই তাঁদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলতে চাননি। যাঁরা বলেছেন, তাঁদের অধিকাংশই নাম প্রকাশ করতে চাননি। অনেকের মনে আফসোস। গোলাগুলি, বিস্ফোরণের উত্তেজনা ছাপিয়ে তাঁদের কেবলই মনে হয়েছে, এ রকম একটা দুর্ধর্ষ লোক, যাঁর ছবি তাঁরা কাগজে বা টিভিতে দেখেছেন, সেই লোক তাঁদের মহল্লায় ঘাঁটি গাড়লেন আর তাঁরা বুঝতেই পারলেন না। পুলিশ বলছে, গুলশান হামলার পরই তামিম চৌধুরী এই বাড়িতে ওঠেন।

নারায়ণগঞ্জ নগরের দক্ষিণে পাইকপাড়ার অবস্থান। পাইকপাড়ার ওপর দিয়ে একটি সরু রাস্তা চলে গেছে মুক্তারপুর সেতু হয়ে মুন্সিগঞ্জ। মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের অনেক লোকই ছোট গাড়ি দিয়ে যাতায়াতের জন্য এই রাস্তাটি ব্যবহার করেন। আর যে বাড়িটিতে জঙ্গিরা আস্তানা গেড়েছিল, তার লাগোয়া কোনো বাড়ি নেই। রাস্তার পাশের ওই বাড়ির একদিকে কবরস্থান, আর তিন পাশের প্লটগুলো খালি। আবার নারায়ণগঞ্জ মডেল থানা ও ফতুল্লা থানার সীমান্তে বাড়িটির অবস্থান হওয়ায় এই জায়গায় পুলিশের নজরদারিও কিছুটা কম ছিল। ওই বাড়িটির মালিক নূরুদ্দীন দেওয়ান একজন প্রবাসফেরত।

ওই বাড়ির পাশের চারতলা একটি ভবনে অবস্থান নেন পুলিশের সদস্যরা। তাঁদের হাতে স্নাইপার রাইফেলও ছিল। ওই চারতলা ভবনটির একজন বাসিন্দা বলেন, সকাল সাতটার দিকে একদল পুলিশ দরজার বেল বাজায়। দরজা খোলার পরপরই তারা নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়ে বাসার সবাইকে নিরাপত্তার স্বার্থে তখনই বেরিয়ে যেতে বলে। পরে পুলিশ সদস্যরা সবাই ফ্ল্যাটে গিয়ে ওঠেন। তাঁদের হাতে অস্ত্র ছিল। পরনে হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ছিল। এসব অস্ত্রধারী তাঁদের ফ্ল্যাটের বারান্দায় অবস্থান নেন। পুরো ভবনটি ঘিরে ফেলা হয়। সকাল নয়টার দিকে গোলাগুলি শুরু হয়। বিকট শব্দে গোলাগুলির মধ্যেই আরও বড় বিস্ফোরণের শব্দও শোনা যায় কয়েকটি। এর মধ্যেই জঙ্গিদের আল্লাহু আকবার স্লোগান ভেসে আসছিল পাশের ওই ভবন থেকে। সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলেন।

ওই ব্যক্তি বলেন, নূরুদ্দীন দেওয়ানের যে ফ্ল্যাটটিতে জঙ্গিরা থাকত বলে বলা হচ্ছে, ওই ফ্ল্যাটটি তাঁদের বাসা থেকে দেখা যেত। জঙ্গিদের ফ্ল্যাটের রান্নাঘরের এক পাশের কাচের জানালা সব সময় খোলা থাকলেও ভেতরের অংশে তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। ফলে কাউকে দেখা যেত না।

জঙ্গি আস্তানার ভবনের ৫০ গজ দূরে আরেকটি ভবনের বাসিন্দা বলেন, সকাল থেকে নূরুদ্দীনের পুরো বাড়ি পুলিশ-ডিবি ঘেরাও করে রেখেছিল। কবরস্থানের দেয়ালসংলগ্ন সড়কে মানুষের হাঁটাচলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সকাল নয়টার দিকে নূরুদ্দীনের বাড়ির ছাদে দুই যুবককে দেখেন তিনি। তাঁদের দুজনের কাঁধে ব্যাগ, একজনের হাতে রাইফেল এবং আরেকজনের হাতে পিস্তল ছিল। তাঁদের আল্লাহু আকবর স্লোগান দিয়ে পুলিশের ওপর বোমা (বা গ্রেনেড) ছুড়তে তিনি দেখেছেন বলে দাবি করেন। তাঁরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিও করেন। তখন অন্যান্য ভবনের ছাদ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বড় রাইফেল দিয়ে গুলি করে। এ সময় তিনি ছাদের ওপরেই এক যুবককে পড়ে যেতে দেখেন। অপরজন ফ্ল্যাটের ভেতরে চলে যান। তিনি ওই ফ্ল্যাটের ভেতরে আগুন জ্বলতে দেখেন। সেখান থেকে কালো ধোঁয়াও বের হচ্ছিল।

নূরুদ্দীনের বাড়ির কাছের চারতলা ভবনের তৃতীয় তলার এক বাসিন্দা বলেন, পুলিশ প্রথমে তাঁদের ফ্ল্যাটে অবস্থান নিলেও পরে তাঁদের ফ্ল্যাটটি ছেড়ে দেয়। তিনিও জঙ্গিদের চিৎকার শুনেছেন। একই ভবনের নিচতলার টিনের ঘরের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি জানান, সকাল ছয়টার দিকেই বিপুলসংখ্যক পুলিশ পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে এবং তাঁদের ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করে। ওই ভবনসহ আশপাশের বাড়িগুলোর ছাদসহ বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ অবস্থান নেয়। নয়টার পর তুমুল গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। সবাই খুব ভয় পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধের সময় এ রকম গোলাগুলি ও বোমার শব্দ শুনেছি।’

বাড়ির মালিক নূরুদ্দীন দেওয়ান বংশপরম্পরায় পাইকপাড়া এলাকাতেই থাকেন। তিনি দীর্ঘদিন কোরিয়ায় ছিলেন। কোরিয়া থেকে ফিরে তিনি পাইকপাড়ায় তিনতলা বাড়িটি তৈরি করেন। ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তিনি স্ত্রী ও তিন ছেলেকে নিয়ে বাস করেন। তাঁর স্বজনেরা জানান, ঈদের দু-চার দিন আগে মুরাদ ও রানা নাম বলে দুই ব্যক্তি আট হাজার টাকায় ওই বাসাটি ভাড়া নেন। তাঁরা নিজেদের একটি ল্যাবরেটরিজের কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিয়েছিলেন।

নূরুদ্দীনের ভাই ও নারায়ণগঞ্জ নগর আওয়ামী লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক কামাল দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সাধারণ মানুষ। তামিম চৌধুরীকে কেমনে চিনব। ধরেন, মেজর জিয়াউল হককে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যও ২০ লাখ টাকা দেওয়া হবে বলা হয়েছে। এখানকার লোকজনকে জিজ্ঞেস করেন তো কেউ তাঁর চেহারা চেনে কি না।’